রজুফার পথচলা
রাজশাহী থেকে ব্রজেন্দ্রনাথ
“ছোট একটি সন্তান আর আমারে একা ফেলে স্বামী মারা যায়। নিজের বাড়ি ভিটাটুকুও ছিলো না। উপায়ন্তর না দেখে সন্তানের মুখে তাকিয়ে বাবার বাড়িতে মাথা গোজার ঠাঁই করে বসবাস করি। নিজের আর সন্তানের পেটের দায় মেটাতে পরের বাড়ি বাড়ি কাজ করেছি আর কোনমতে জীবন চালিয়ে যাচ্ছি। নিজের অধিকার সম্পর্কে জানতাম না এবং কি, কোথায় গিয়ে কি পাবো কখনো তা নিয়ে চিন্তাও আসেনি।” কথাগুলো বলছিলেন রাজশাহীর বড়গাছী ইউনিয়নের মাধবপুর গ্রামের বিধবা রজুফা ।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের কারণে অকালে স্বামী হারিয়ে বিধবা হলেও তিনি এখন সচেতন মানুষ হিসেবে সমাজে তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। আর প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছেন নিজেকে আরো সক্রিয় মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে। এই কাজের ধারাবাহিকতায় তিনি বিধবা ভাতার জন্যও মনোনীত হয়েছেন।
১৯৯৯ সালে রাজশাহীর শিশাপাড়া গ্রামের মো. কালামের সাথে রজুফার বিয়ে হয়। অভাবী সংসার, দিন এনে দিন খাওয়া। বিয়ের মাত্র তিন বছরের মাথায় একটি পুত্র সন্তান জন্মের কিছু দিনপরই তার স্বামী মারা যান। কম বয়সে স্বামী মারা যাওয়া এবং নিজের অপরিচিত একটি গ্রামে স্বামীহীন ছোট সন্তান নিয়ে আবার তিনি ফিরে আসেন তার চিরচেনা মা বাবার বাড়িতে, সন্তানটিকে মানুষ করা উদ্দেশ্য। কিন্তু রজুফার বাবাও মারা যাবার কারণে তার বয়স্ক মায়ের ভরণপোষণের দায়িত্বও এসে পড়ে তার কাঁধে। তিন সদস্যের এই সংসারের রুটি রুজি জোগার করতেই সারাদিন তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়। শীত, বর্ষা, খরা ও রোদ সহ্য করেই কখনো মানুষের মরিচের ক্ষেতে, কখনো সবজি ক্ষেতে, কখনো মানুষের বাড়িতে রান্নাসহ ধান সিদ্ধ করে তাদের জীবন চলে।
কথা প্রসঙ্গে রজুফা বলেন, “আমার ছেলেটি জেএসসি তে ৪.২৫ এবং এসএসসি তে ৪.০০ পয়েন্ট পেয়েছে। আমি তাকে আর পড়াতে পারছি না। কারণ আমার পক্ষে তার লেখাপড়ার খরচ চালানো কোনভাবে সম্ভব নয়। কিন্তু আমার ছেলেটি কলেজে পড়তে চায়। সে নিজে জোর করে ভর্তি হয়েছে। ভর্তি হওয়ার পর আমি কোন মতো ৪টি বই কিনে দিয়েছি। দুই বছরের জন্য নাকি আরো ৮টি বই কিনতে হবে, যা আমার পক্ষে তা সম্ভব হচ্ছে না । আমার ছোট একটি গরু এবং একটি ছাগল আছে। তা বিক্রিরও উপযোগী নয় । একটি ঋণের এনজিওতে ভর্তি হয়েছি। সঞ্চয় করি। ভাবি ঋণ তুলে সন্তানের বই কিনে দোবো। কিন্তু ভয় হয়।”
এরই মাঝে মাধবপুর গ্রামের রজুফার মত নারীরা নিজেদের সমস্যা সমাধানে এবং সম্ভাবনার দিকগুলো যৌথভাবে এগিয়ে নেবার লক্ষ্যে একটি নারী সংগঠন দাঁড় করেন। ২০১৬ সাল থেকে সংগঠনটিতে নিয়মিত সেবা এবং নিজেদের সম্ভাবনার দিকগুলো আলোচনা হবার ফলে তাঁদের নিজস্ব উদ্যোগ বেড়ে গেছে। এই সংগঠনের মাধ্যমে গ্রামের নারীরা তাদের অধিকার এবং মর্যাদা ফিরে পাচ্ছেন। সঠিক তথ্য জানা এবং কার্যকর যোগাযোগের ফলে বিভিন্ন সেবা প্রাপ্তিও বেড়ে গেছে। রজুফা বলেন, “আমি পূর্বাশা নারী সংগঠনের সাথে জড়িত। এর আগে আমি বিধবা ভাতা কার্ডের জন্য অনেকসময় মেম্বার ও চেয়ারম্যানের সাথে যোগাযোগ করেছি কিন্তু কাজ হয়নি। পূর্বাশা নারী সংগঠনের সভায় যখন একদিন বসলাম তখন জানতে পারি কিভাবে এবং কারা সেবা পাওয়ার যোগ্য! আলোচনায় তখন অন্যান্য সংগঠনের সদস্যরা আমার কথা তুলে ধরলেন।” তিনি আরও বলেন, “সভানেত্রী মোসাঃ মনিরা বেগমসহ সকলে আমাকে নিয়ে চেয়ারম্যানের কাছে নিয়ে যাবার পরিকল্পনা করলেন। এর ফলে আমার নামটি বিধবা ভাতা কার্ড পাওয়া নামের তালিকায় যুক্ত করেন। আমি এখন ৩ মাস অন্তর অন্তর ১২০০ টাকা করে পেয়ে থাকি। তাতে করে বেশি না হলেও সংসারের কিছুটা উপকারে এসেছে।”
রজুফা এখন তার বাড়ির আশপাশে জৈব পদ্ধতিতে সবজি আবাদ করেন। সবজি ক্ষেতে তিনি কেঁেচা কম্পোস্ট সার ব্যবহার করেন। তার ইচ্ছা কেঁেচা কম্পোস্ট তৈরি করবেন এবং সেই সার বাজারে বিক্রির মাধ্যমে সংসারের জন্য আয় করবেন। সংগঠন করার কারণে রজুফা মধ্যে সচেতনতা তৈরি হলো। তিনি এখন বিশ্বাস করেন সম্মিলিত শক্তিতে যেকোন কিছু আদায় করা সম্ভব। আর এজন্য প্রয়োজন একতাবদ্ধভাবে কাজ করার। তিনি বলেন, “সঠিক তথ্য এবং জেনে বুঝে সকলে মিলে যোগাযোগ করলে সেবা পাওয়া কঠিন নয়।” পূর্বাশা নারী সংগঠনের সভাপতি মোসা: মুনীরা বেগম বলেন, “গ্রামের নারীদের সংসার জীবন কাটে অনেক কষ্টের মধ্যে দিয়ে। আসলে একতাবদ্ধ আর তথ্য জানা থাকলে সেবা পাওয়া যায়। কঠিন কিছু নয়। আমরাও এখন তাই করছি ”