উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের মহীরুহ মানুষটি মানিকগঞ্জের হীরালাল সেন
মানিকগঞ্জ থেকে এম.আর.লিটন
ইউরোপ, উত্তর আমেরিকার বাইরে এশিয়া-আফ্রিকা-ল্যাসেই হিসেবে উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের এই মহীরুহ মানুষটির নাম হীরালাল সেন। হীরালাল সেনের গ্রামের বাড়ি ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জের বকজুরিতে। উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে তাঁর যে অবদান, তা অনেকে বিস্মৃত হলেও তাঁকে মনে রেখেছেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট-এর ছাত্র শিক্ষকেরা এবং কয়েকজন চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষও। হীরালাল সেনের জন্মদিন ২ রা আগস্ট।
তাঁর জন্মদিন সম্প্রতি তাঁর জন্মস্থান বকজুরি প্রাইুমারী স্কুল প্রাঙ্গণে আলোচনা সভা, চলচ্চিত্র প্রদর্শনীসহ নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে চলচ্চিত্রসঙ্গ পর্বে প্রদর্শিত হয় শরীফ রেজা মাহমুদ-এর ‘অঙ্কুরোদগম’, জুয়েইরিযাহ মউ-এর ‘প্রাফিতি’, আবিদ মল্লিক এর ‘পথ’, কামরুল আহসান লেনিন এর ‘ঘ্রাণ’, আহমেদ হিমু-র ‘ওঙ্কার’, শাহজাহান শামীম-এর ‘বেয়াদব, শৈবাল এর ‘চিলেকোঠা’, হাবিবুর রহমান এর ‘দুখিয়ার কুঠি’, শহিদুল আলম-এর ‘আরনেস্ট’সহ আরো বেশকিছু চলচ্চিত্র। এছাড়াও প্রদর্শিত হয় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইন্সস্টিটিউট-এর চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রশিক্ষণ (স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা) কোর্সের ২য় ব্যাচের শিক্ষার্থীদের দ্বারা নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্র ‘গন্তব্য বকজুরী’। বীরমুক্তিযোদ্ধা আজহারুল ইসলাম আরজু বলেন, “হীরালার সেন মানিকগঞ্জ জেলার গর্ব,কিন্তু এই মহান মানুষটির নামে মানিকগঞ্জে কোন স্থাপনা নেই ।হয়তো অনেকে এই মহান মানুষটির নাম যানে না ।এই মহীরুহ মানুষটির আজ ১৪৯তম জন্মদিন আমাদের দাবি স্মরণীয় কিছু করা হোক, যাতে যুগের পর যুগ সবাই তাঁকে স্মরণ করবে ।”
উল্লেখিত ‘ইউকিপিডিয়া’র তথ্যে জানা যায়,“হীরালাল সেন (১৮৬৬-১৯১৭) ছিলেন একজন বাঙালি চিত্রগ্রাহক, যাঁকে সাধারণত ভারতের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একজন বলে গণ্য করা হয়। এছাড়া, তাঁকে ভারতের সর্বপ্রথম বিজ্ঞাপনবিষয়ক চলচ্চিত্রের নির্মাতা বলেও গণ্য করা হয়। সম্ভবতঃ ভারতের প্রথম রাজনীতিক ছবিও তিনিই বানিয়েছিলেন। ১৯১৭ সালে এক অগ্নিকান্ডে তাঁর তৈরি সকল চলচ্চিত্র নষ্ট হয়ে যায়।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
হীরালাল সেনের জন্ম ১৮৬৬ সালে মানিকগঞ্জ জেলার বগজুরি গ্রামে। তাঁর পিতার নাম চন্দ্রমোহন সেন, মাতা বিধুমুখী। পিতামহ গোকুলকৃষ্ণ মুনশি ছিলেন ঢাকার জজ আদালতের নামকরা আইনজীবী। পরে তিনি কোলকাতা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে যোগ দেন। পিতা মাতার আট সন্তানের মধ্যে হীরালাল ছিলেন দ্বিতীয়। মানিকগঞ্জ মাইনর স্কুলে তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয়। একই সাথে মৌলভী সাহেবের কাছে ফারসী ভাষাও শিখতেন। ১৯৭৯ সালে মাইনর পরীক্ষা পাস করে ঢাকার কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। পরে পিতার সাথে হীরালাল কোলকাতা গিয়ে কলেজে ভর্তি হন। আই.এস.সি. অধ্যয়ন কালে চলচ্চিত্রের প্রতি ভীষণভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়াায় যবনিকাপাত ঘটে।
প্রাথমিক জীবন
হীরালাল সেনের আদি বাড়ি ছিল ঢাকা থেকে প্রায় ৮০ কিমি. দূরে বর্তমান বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ জেলায় । যদিও তিনি সেই এলাকার এক জমিদার বংশের এক উকিলের ছেলে ছিলেন, তাঁর শৈশব কেটেছিল কলকাতেই। ১৮৯৮ সালে, প্যরিসের ‘পাথে ফ্রেরেস স্টুডিও’র সদস্য অধ্যপক স্টিভেনসনের একটি নাতিদীর্ঘ ছবি কলকাতার স্টর থিয়েটারে দেখানো হয়, The Flower of Persia (পারস্যের ফুল) নামে একটি আপেরার সঙ্গে। স্টিভেনসনের ক্যামেরা ধার করে নিয়ে হীরালাল বানান তাঁর প্রথম ছবি : A Dancing Scene From the Opera, The Flower of Persia, ওই অপেরার একটি নাচের দৃশ্য নিয়েই। ভাই মতিলাল সেনের সাহায্যে লন্ডনের ওয়ারউইক ট্রেডিং কম্পানীর চার্লস আরবানের থেকে তিনি একটি ‘Urban Bioscope’ কিনে নেন। পরের বছর তিনি ভাইয়ের সাথে রায্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানীর গোড়াপত্তন করেন
সংসার জীবন
হীরালালের বিয়ে হয় হেমাঙ্গিনী দেবীর সাথে। তাঁদের তিন সন্তানের কথা জানা যায়। প্রথম পুত্র বৈদ্যনাথ সেন ১৯০২ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। তৃতীয় সন্তান মেয়ে প্রতিভা সেন তথির বিয়ে হয় নরনাথ সেনের সাথে। নরনাথ সেনের ভাইপো দিবানাথ সেনের স্ত্রী ছিলেন কিংবদন্তির নায়িকা সুচিত্র সেন।
কর্মজীবন
হীরালাল সেনের সৃষ্টিশীল কর্মজীবন ব্যাপ্ত ছিল ১৯১৩ অবধি, যার মধ্যে তিনি চল্লিশটিরও বেশি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। বেশিরভাগ ছবিতেই তিনি ক্যামেরাবদ্ধ করেন অমরেন্দ্রনাথ দত্তের কলকাতার ক্লাসিক থিয়েটার মঞ্চস্থ বিভিন্ন থিয়েটারের দৃশ্য। সেই যুগে ব্যবহারযোগ্য ফিল্ম আনা হত বিদেশ থেকে। ১৯০১ আর ১৯০৪-এর মধ্যে ক্লাসিক থিয়েটারের পক্ষে তিনি অনেকগুলো ছবি নির্মাণ করেন। যথা: ভ্রমর, হরিরাজ, বুদ্ধদেব ইত্যাদি। তাঁর সৃষ্ট ছবির মধ্যে একটি ছিল পূর্ণদৈর্ঘ্যে ১৯০৩-এ তৈরি আলিবাবা ও চল্লিশ চোর (“Alibaba and the Forty Thieves”), যেটি বানানো হয়েছিল ক্লাসিক থিয়েটারে অভিনীত ওই নামের থিয়েটারের ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু এ ছবির বিষয়ে বিশেষ কিছু জানা যায় না; কারণ সম্ভবতঃ কোনোদিনই এ ছবির প্রদর্শন হয়নি। বাণিজ্যিকভিত্তিতে তিনি কতকগুলো বিজ্ঞাপন বিষয়ক আর কিছু সংবাদমূলক চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেন। তিনি ‘জবাকুসুম হেয়ার অয়েল’ আর ‘এডওয়ার্ডস টনিক’-এর ওপর বিজ্ঞাপনী ছবি বানিয়েছিলেন। সম্ভবতঃ, ভারতীয়দের মধ্যে বিজ্ঞাপনে ফিল্ম ব্যবহার করায় তিনিই প্রথম ছিলেন।
ভারতের প্রথম রাজনীতিক চলচ্চিত্র:
হীরালালের তৈরি তথ্যছবি “Anti-Partition Demonstration and Swadeshi movement at the Town Hall, Calcutta on 22nd September 1905” ভারতের প্রথম রাজনীতিক চলচ্চিত্র বলে গণ্য করা হয়। ১৯০৫-এর ২২শে সেপ্টেম্বর কলকাতার টাউন হলে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের একটি প্রতিবাদ সভা হয়েছিল, এ ছবিতে তাকেই ক্যামেরাবদ্ধ করা হয়। ১৯০৫-এ ছবির বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল , “আমাদের নিজেদের স্বার্থে খাঁটি স্বদেশী সিনেমা”। ছবির শেষে গাওয়া হযয়েছিল “মন্দে মাতরম” ।
পরবর্তী জীবন
রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি প্রথম ছবি বানায় ১৯১৩ সালে। এরপর হীরালাল অনেক দুর্গতি আর অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হন। এরফিনস্টোন বায়োস্কোপ কোম্পানির জামশেদজি ফ্রেমজি ম্যাডান তাঁর থেকে অনেক বেশি সাফল্য অর্জন করেন। এর ওপর হীরালাল ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগে এক অগ্নিকান্ডে তাঁর তৈরি সমস্ত ছবি নষ্ট হয়ে যায়।”