একজন উম্মে সাহেরা খাতুন ও মানিকগঞ্জের প্রথম শহীদ মিনার
আব্দুর রাজ্জাক, মানিকগঞ্জ
ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ, বীর ভাষা যোদ্ধা রফিক এর মানিকগঞ্জ জেলায় প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছিল ১৯৫৪ সালে। এই ইতিহাসের সাক্ষ্য বহনকারী একজন নারী উম্মে সাহেরা খাতুন। অনেকেই জানেন না তাঁর সেই অবদানের কথা। কালের পরিক্রমায় সেই ইতিহাস আজ মুছে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে!
মানিকগঞ্জ ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৫৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তৎকালীন ছাত্র-জনতার উদ্যোগে মানিকগঞ্জের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভাষা শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মাণের আহবান জানানো হয়। নির্মিতও হয়ে যায় বেশ কিছু শহীদ মিনার। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের রোষানলে সেগুলোর একটিও মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। ভেঙে ফেলা হয় সব ক’টি শহীদ মিনার। ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর স্বপ্ন অধরা রয়ে যাবার শঙ্কা জেগে উঠে। কিন্তু ছাত্র-জনতার মন ছিল অনড়। শহীদ মিনার হবেই। শুরু হল জায়গার সন্ধান। অবশেষে মিলেও গেল। এগিয়ে এলেন যুক্তফ্রন্ট সরকারের তৎকালীন মন্ত্রী আব্দুল লতিফ বিশ্বাসের সহধর্মিণী উম্মে সাহেরা খাতুন।
মানিকগঞ্জ শহরের এস.কে গার্লস স্কুলের সামনেই সাহেরা খাতুনের বাড়ি। ছাত্র নেতৃবৃন্দ তাঁর বাড়ির সামনের খোলা জায়গায় রাস্তা ঘেঁষে শহীদ মিনার নির্মাণের প্রস্তাবনা সাহেরা খাতুনের কাছে উত্থাপন করেন। সরকারের সেই মুহূর্তের অগ্নিদৃষ্টির কথা সাহেরা খাতুন ভালোই জানতেন। তারপরও কাল বিড়ম্বনা না করে অনুমতি দিলেন।
দিনটি ছিল ২০ই ফেব্রুয়ারি। পরের দিনই শহীদ দিবস। যে করেই হোক যত ছোটই হোক শহীদ মিনার হবে। ছাত্র নেতারা বুলেট গতিতে ইট, বালু, সিমেন্ট যোগার করে ছোট্ট একটি ইটের স্তম্ভের আকারে শহীদ মিনার তৈরি করলেন সেই দিনের মধ্যেই। মানিকগঞ্জ শহরে শহীদ মিনার নির্মান করা হয়েছে এ খবর পৌঁছাতে দেরি হয়নি প্রশাসনের কাছে। সে সময়ের এসডিও ছিলেন এ.কে.দত্ত চৌধুরী। তিনি বিপুল সংখ্যক পুলিশ নিয়ে হাজির হলেন শহীদ মিনার গুড়িয়ে দেয়ার জন্য। তবে এসবের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন সাহেরা খাতুন। অসীম সাহসে সেই পুলিশ বাহিনী এবং শহীদ মিনারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করলেন; তেজদীপ্ত কন্ঠে হুংকার দিয়ে বললেন, “আমার জায়গায় আমি শহীদ মিনার বানিয়েছি। কার সাহস তা ভাঙে?” তার এই হুংকার ও যৌক্তিক কথায় থেমে গেলেন এসডিও এবং পুলিশ বাহিনী। তারা আর সাহেরা খাতুনকে সরিয়ে দিয়ে শহীদ মিনার ভাঙার সাহস পেলেন না।
১৯৫৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। ছাত্রজনতার ঢল নেমেছিল এই শহীদ মিনারের বেদীতে। ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে গিয়েছিল শহীদ মিনারের বেদী। কিন্তু ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চের পর এ শহীদ মিনারটি মাটির সাথে মিশিয়ে দেয় পাকহানাদার বাহিনী।
১৯৭২ সাল। দেশ স্বাধীন হবার পর ঠিক একই স্থানে একই অবয়বে পুনরায় গড়ে তোলা হয় শহীদ মিনারটি। এটিই মানিকগঞ্জের প্রথম শহীদ মিনার। ১৯৭২ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ভাষা দিবসের মূল অনুষ্ঠানমালা, শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন সবই হয়েছে এই শহীদ মিনারকে কেন্দ্র করে। শুধু তাই নয়। পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে স্বৈরাচারী সরকারে বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামের প্রেরণারও উৎসও ছিল এই শহীদ মিনার।
২০০৭ সালে মানিকগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যাালয়ের মাঠের পাশে প্রশাসনের উদ্যোগে মানিকগঞ্জের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মিত হলে প্রায় পরিত্যক্ত হযে যায় প্রথম তৈরি সাহেরা খাতুনের শহীদ মিনারটি। অযতœ আর অবহেলায় ভেঙে যায় ইটের গাঁথুনীর ছোট্ট শহীদ মিনার। যদিও সাংস্কৃতিক কর্মী-সংগঠকদের দাবির মুখে মানিকগঞ্জ পৌরসভা মূল শহীদ মিনারটির নতুন করে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে।
মানিকগঞ্জের প্রথম শহীদ মিনার হিসেবে যে সমন্মান তা ফিকে হয়ে যায়। একুশে ফেব্রুয়ারির দিনে আশেপাশের পাড়ার ছেলেমেয়েরা ছাড়া কেউ খোঁজ রাখেনা মিনারটির, ফুলশূন্য লয়ে বেদীটি পরে থাকে। পাশাপাশি মানিকগঞ্জের প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের পিছনে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা অসীম সাহসী নারী উম্মে সাহেরা খাতুনের নাম মানিকগঞ্জ থেকে মুছে গেছে। গত প্রায় ৫ যুগ ধরে উম্মে সাহারা খাতুনকে কেউ স্মরণ বা মনে রাখেনি।
ভাষা শহীদদের তাজা রক্তের রক্তিম আভাকে জমিনে শ্রদ্ধা জানাতে উম্মে সাহেরা খাতুনসহ তাঁর মত আরো অনেকের অবদান চিরকাল অম্লান থাকুক।