আটপাড়ায় আলু উৎপাদনে সমস্যা: প্রতিকারের খুঁজে কৃষকরা
আটপাড়া, নেত্রকোনা থেকে পার্বতী রাণী সিংহ
“অল্প দিনে ও অল্প পরিশ্রমে আলু চাষ করেছিলাম লাভবান হবার জন্য, কিন্তু এ বছর আলু চাষ করে লাভ তো দূরে থাক বরং ব্যাপক লোকসান হলো’। কথাগুলো বলছিলেন আটপাড়া উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামের কৃষক সবুজ মিয়া। শ্রীরামপুর গ্রামের উচুঁ ভিটের প্রায় ৪৫০ থেকে ৫০০ কাঠা জমিতে কৃষকরা কম সেচ লাগে এমন বিভিন্ন ধরনের ফসল, যেমন- গম, সরিষা, আলু, তিল, লাউ, মূলা, মরিচ ইত্যাদি নিয়মিত চাষ করেন। কোন বছর সরিষা ভালো হয় তো আবার কোন বছর আলু, পাট, গম। কৃষকরা তাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে অধিক ফসল উৎপাদনের জন্য নিরন্তর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। কিন্ত মাঝে মাঝে ফসলে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া নামক রোগের আক্রমণ ও প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। আর তখনই কৃষকরা মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে শুরু করেন এটা কি হল আর কেনই বা হল এবং কি করা যায়? এ বছর আলু চাষ করে তেমনই কৃষকদের মাথায় হাত।
প্রতিবছরের ন্যায় এ মৌসুমেও শ্রীরামপুর গ্রামের ভিটা জমিতে প্রতিবেশীদের নিয়ে দল বেঁধে ক্ষেতে আলু তুলছে কৃষক-কৃষাণীরা। যেতে যেতে আলাপ হয় এ গ্রামেই কৃষক শহীদ মিয়ার সাথে। তার মনটা খুব খারাপ। ভালো আছেন কিনা জিজ্ঞেস করতেই বললেন, “ভালো নেই। শরীর ভালো না আর ঔষুদের পিছনে অনেক টাকা খরচ হইতাছে। অন্যদিকে ২ কাঠা (২০ শতাংশ) জমিতে আলু করছি। এই বছর কোন ফলনই হয় নাই। গাছগুলো বড় ও তড়তাজা হইছে তারপরেই মইরা গেছে। কিয়ের থাইক্ক্যা হইলো বুঝতাছিনা। মাটিতে রস ছিল সব ঠিকঠাকই ছিল। হঠ্যাৎ কইরা গাছগুলো পুইড়া গেছে। আলু অধের্কটা পচা, পুকে খাওরা। খালি আমার না, এই ভিটার প্রায় ৭০ জন কৃষকের একই অবস্থা। ফলন না হইলে কি বেচাম আর কি খায়াম?”
আরেক কৃষক হাসেন আলী বলেন, “যা খরচ করছি সবটাই লসে গেছে। আলু ছোট ছোট, পরিমাণেও কম হইছে, নষ্ট হইছে। গেল বছর ২ কাঠা (২০ শতাংশ) জমিতে আলু পাইছি ৩০ মণ আর এবছর ১০ মণ। জমিতে আলু চাষ করতে যে খরচ (জমি চাষ, বীজ, সার, কীটনাশক, শ্রম) হইছে এ বছর আর খরচ তুলা যাইব নাহ।”
এ বছর আলুর ফলন কম হওয়ার কারণ সম্পর্কে মতামত দিতে গিয়ে কৃষক হাসেন আলীর বলেন, “হয়তো বীজ লাগানোর সময়টা আগে পরে হইছে। কিছু বুঝতাছি না। এই বছর বীজ রাখলে পরেরবার রোগ হয় কিনা চিন্তায় আছি।”
এভাবে আলু নষ্ট হওয়ার জন্য একেক কৃষক একেক মন্তব্য করেন। তারা কেউই সঠিকভাবে বলতে পারছে না কি কারণে এবছর ফসল নষ্ট হলো এবং কি ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এজন্য তারা প্রাথমিক পর্যায়ে স্থানীয় কৃষি অধিদপ্তরের উপ সহকারীর সাথে আলোচনার সিদ্ধান্ত নেয়।
সে মোতাবেক গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ শ্রীরামপুর গ্রামের কৃষক লতিফ মিয়ার বাড়িতে আলু ফসলের সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়। কৃষকদের মুখে আলু ফসলের সমস্যার কথা শুনে এবং আক্রান্ত আলু গাছ ও আলু ফসল দেখে কৃষি কর্মকর্তা বলেন, “সাধারণত আর্দ্র আবহাওয়াতে এ ধরনের রোগ বেশি দেখা দেয়। তাপমাত্রার তারতম্যের কারণেই রোগটি দেখা দেয়। এটি মূলত ছত্রাকজনিত রোগ। যা নতুন চারাতে আক্রমণ করে এবং সহজে পচন ধরায়। খুব অল্প সময়ে গাছগুলো মরে যায়। গাছ পুড়ে যাওয়ার মতো হয়, আর এ রোগটির নাম হল আরলি ব্রাইট (আগাম হলে), আর পরে রোগটি হলে তাকে লেইট ব্রাইট বলা হয়”। এ রোগটি সাধারণত আলু ও টমাটো ফসলে আক্রমণ করে। তিনি ক্ষেতে এধরণের ছত্রাকের আক্রমণ হলে ছত্রাকনাশক ব্যবহার করার পরামর্শ দেন। এছাড়াও তিনি কৃষকদেরকে কেইল/আইল করে সারিবদ্ধভাবে আলু চাষের পরামর্শ দেন। আইল করে আলু চাষ করলে আলুর ফলন বেশি হয় বলে তিনি জানান।
কৃষি কর্মকর্তা ছত্রাক আক্রান্ত জমি থেকে আলু বীজ না রাখার জন্য কৃষকদের পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ছত্রাকমুক্ত জমি থেকে পরিপক্ক আলু বীজ সংগ্রহ করে ছায়াতে শুকাতে হবে। ছায়াতে বীজ শুকানোর পর আলো বাতাস প্রবেশ করতে পারে এমন ঘরে মাঁচার উপর বাঁশের চাটাই/চটের বস্তা বিছিয়ে চাটাই বা চটের বস্তায় ধুলো/বালু এক ইঞ্চি পরিমাণ বিছিয়ে আলু বীজ সংরক্ষণ করতে হবে। বীজগুলো এক থেকে দুই মাস পরপর বাছাই করে দিতে হবে। কোন আলু পচে গেলে সেগুলো দ্রুত সরিয়ে ফেলতে হবে। বীজ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে স্থানীয় আর একটি পদ্ধতি হল পরিপক্ক বীজ নেটের ব্যাগে ঘরের আড়া/বাঁশের আড়ায় ঝুলিয়ে সংরক্ষণ করলে বীজে আলো বাতাস সহজে প্রবেশ করতে পারে এবং বীজ ভালো থাকে ও বীজে ছত্রাক আক্রমণের আশংঙ্কা কম থাকে। এভাবে বীজ সংরক্ষণ করলে ইঁদুরের আক্রমণ থেকেও আলু বীজ রক্ষা করা সহজ হয়।
তিনি কৃষকদেরকে উচুঁ জমিতে বোরো মৌসুমে ধানের চাষ না করে ক্রমান্বয়ে আলু, গম, সরিষা, পাট ও আগাম জাতের আমন ধান চাষ করার পরামর্শ দেন। এতে করে জমির মাটিতে জৈবসার তৈরি হবে, মাটিতে সারের পরিমাণ কম লাগবে এবং ফলনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।
কৃষি কর্মকর্তা সরেজমিনে মাঠ পরিদর্শন করে কৃষকদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে সমস্যা থেকে উত্তরণে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়ার ফলে চলতি মৌসুমে আলু বীজ সংরক্ষণে কৃষকরা উপকৃত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন। তারা গ্রামীণ লোকায়ত পদ্ধতিতে আলু বীজ সংরক্ষণের উপায় সম্পর্কে জানতে সক্ষম হয়েছে, যা আগামী মৌসুমে সঠিক উপায়ে এবং নিরাপদে আলু চাষে কৃষকদের সহায়ক হবে।