একজন হুসনা আক্তারের উদ্যোগ
:: নেত্রকোনা থেকে মো. আব্দুর রব
নেত্রকোনা শহর থেকে সাত কিলোমিটার পূর্বদিকে নেত্রকোনা মদন রোডে পিচের মাথায় পাশেই হাসামপুর গ্রামটি অবস্থিত। সেই গ্রামেই ভূমিহীন উদ্যোগী নারী হুসনা আক্তারের বসবাস। স্বামী মতুর্জা আলীসহ পরিবারের সদস্য সংখ্যা সাতজন। স্বামী কৃষিকাজ করেন। তবে বর্তমানে তাঁদের নিজস্ব কোন জমি না থাকায় তাঁর স্বামী দিনমজুরি করেন।
একসময় স্বামী সংসার নিয়ে ভালোই চলছিল তাঁর জীবন। হঠাৎ বড় ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ছেলের চিকিৎসার জন্য তিনি তাঁর ১৯ শতাংশ বসতভিটা ছাড়া বাকি ৮০ শতাংশ আবাদী জমি বিক্রি করেন। আবাদী জমি বিক্রি করে সন্তানকে তো বাঁচাতে পারেননি বরং জমিগুলো বিক্রি করায় তিনি হয়ে পড়েন ভূমিহীন। সংসার চালানোর জন্য তাই তাঁর স্বামীকে সিলেটে গিয়ে কাজ করতে হয়, কিন্তু তাতেও অভাব মুছেনি তাঁদের। তাঁর স্বামীর কর্মস্থল সিলেটে ৩/৪ বছর থেকে আবার ফিরে আসেন নিজ গ্রামে। সংসারে তাই অভাব লেগেই থাকতো।
সংসারের অভাব দূর করার জন্য তিনি অভিনব একটি উদ্যোগ নেন। বসতভিটাসহ ১৯ শতাংশ জমিতে তিনি যেহেতু ধান আবাদ করতে পারছেন না তাই সেখানে জৈব পদ্ধতিতে সবজি চাষ শুরু করেন। বাড়ির চারপাশে এমনকি উঠানে মাচা তৈরি করে সবজি আবাদ করেন বছরজুড়ে। শিম, ডাটা, আলু, মিষ্টি আলু, বরবটি, শীতলাউ, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, মূলা, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, পুঁইশাক, করলা, বেগুন, বিলাতিধনিয়া, কচু, ঢেঁড়স, পেঁপেসহ নানান রকমের মৌসুমি ফসলাদি আবাদ করেন এই স্বল্প জমিতে। একান্ত যত্নে ও পরিচর্যায় তিনি ভালো ফলন ফলাতে সক্ষম হয়েছেন।
অন্যদিকে হুসনা আকতার সবজি চাষে কেঁচো কম্পোস্ট, গোবর, ছাঁই ও হাঁস মুরগির বিষ্ঠা ব্যবহার করায় ভালো ফলন পেয়েছেন বলে জানান। বিষমুক্ত সবজি আবাদ করায় এলাকায় তাঁর সবজির চাহিদা রয়েছে। তিনি বলেন, “আমার সবজির চাহিদা বেশি, বাজারে নিলে তাড়াতাড়ি বিক্রি হয়। এমনকি বাড়ি থেকে এসে লোকজন সবজি নিয়ে যায়। কারণ আমার সবজিতে কোন বিষ বা সার দেই না, খাইতে স্বাদ লাগে।”
সবজি ছাড়াও হুসনা আক্তারের বাড়িতে আছে ২০-২৫টি পেঁপে গাছ। এই গাছে সারাবছরই পেঁপে ধরে। সবজির বীজ রোপণের পর থেকে ফসল হওয়ার আগে পর্যন্ত যখন কোন কিছু বিক্রি করার থাকে না। সেই সময়টাতে তিনি পেঁপে বিক্রি করেন। তাছাড়াও তাঁর সামান্য বসতভিটায় আছে লেবু, আখ, আদা, হলুদ, সুপারি ও পেঁয়ারা গাছও। এ সমস্ত গাছের ফসল বিক্রি করেও তিনি বাড়তি আয় করেন, যা তাঁর সংসার চালানোর কাজে আসে। বারোমাসি মরিচের গাছ থেকে সারা বছরের সংসারের চাহিদা মেটানোর পর বাকি মরিচ তিনি বিক্রি করেন।
সংসারের কাজের পাশাপাশি সবজি বাগানের বেশির ভাগ পরিচর্যা তিনি নিজেই করেন। তাঁর স্বামী ও সন্তানেরাও এ কাজে তাঁকে যথেষ্ট সাহায্য করে থাকেন। যেমন, ফসল তোলা, বাজারে নেওয়ার জন্য গুছিয়ে দেওয়া, বাজারে নিয়ে বিক্রি করা ইত্যাদি কাজ তাঁরা করেন।
হুসনা আক্তার নিজের ফসল থেকে বীজ সংগ্রহ করে পরবর্তী মৌসুমে চাষাবাদের জন্য সংরক্ষণ করেন। গ্রামের অন্যন্যা কৃষককেও তিনি তাঁর সংরক্ষিত বীজ বিনিময় করেন। এতে করে তাঁদের সাথে বোঝাপড়া তৈরি হয় এবং বিভিন্ন সময়ে তাঁরা পরস্পরকে সহযোগিতা করেন। হুসনা আক্তার জানান, সবজি অন্যান্য ফসল বিক্রি করে তিনি বছরে প্রায় ৬০ হাজার টাকা আয় করেন। এই টাকা দিয়েই তিনি তাঁর ছেলে মেয়েদের পড়াশুনাসহ সংসারের সব ধরনের খরচ চালান। হুসনা আক্তার বলেন, “সবজি চাষে আমার সাফল্য দেখে গ্রামের অন্যান্য নারীরাও এগিয়ে আসছেন বিষমুক্ত সবজি চাষে। আমি তাঁদের সহযোগিতা করি, পারমর্শ ও বীজ দিই। এতে আমি আনন্দ পাই।”