সামাজিক উন্নয়নে চন্দ্রডিঙ্গা যুব সংগঠনের উদ্যোগ

কলমাকান্দা নেত্রকোনা থেকে অর্পণা ঘাগ্রা

সমাজ উন্নয়নের দায় ও দায়িত্ব প্রত্যেক সামাজিক জীব মাত্রের উপরই বর্তায়। কেউ এড়িয়ে চলে আবার কেউবা আত্মনিয়োগ করে। এক্ষেত্রে চন্দ্রডিঙ্গা যুব সংগঠন তাদের সক্ষমতার ভিত্তিতে সামাজিক উন্নয়নে উদ্যোগ গ্রহণ করে চলেছেন ধীরে ধীরে। এই সংগঠনটি ২০১৪ সালে গঠিত হয় সমাজের উন্নয়নে যুব শক্তিকে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে। এই পর্যন্ত তাদের উল্লেখযোগ্য উদ্যোগগুলো তুলে ধরছি।

বসতভিটা ও ফসলী জমি রক্ষার্থে বাঁধ তৈরি
সীমান্ত অধ্যূষিত চন্দ্রডিঙ্গা গ্রামটি রংছাতি ইউনিয়নের কলমাকান্দা উপজেলায় অবস্থিত। পাহাড়ি ঢল ও পাহাড়ি বালির দূর্যোগ মোকাবেলা করতে হয় প্রতি বর্ষাকালে এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীদের। পাহাড়ি ঢলের সাথে আসা বালিতে ভরাট হয়ে গেছে চন্দ্রডিঙ্গা ছড়াটি (ঝর্ণা)। তাই ঢলের পানির ধারন ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে ছড়ার। সেই কারণে ঢলের পানি ছড়া উপচে ফসলী জমি ও বসতভিটাতে প্লাবিত হচ্ছে এবং কোন কোন স্থানে ছড়ার পাড় ভাঙছে। এই সব ভাঙা পাড়ে এবং বসত ভিটার চারপাশে বাঁধ দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে যুব সংগঠন। বাঁধ রক্ষার জন্য পাড়ে ইকর, কাশবন, কলাগাছ, কলমি, খেঁজুর, তাল রোপণ করেছেন। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে সিমেন্টের খালি বস্তায় বালি ভরে ভাঙন রোধ করেছেন। এতে উপকৃত হয়েছে পুরো গ্রামবাসী।

Photo0930

বালি ও পতিত জমি চাষের আওতায় আনা
এই এলাকার বালিতে ভরাট হওয়া জমি ও পাহাড়ের পাদদেশের জমিগুলো পতিত পড়ে থাকে। তাই বালি জমি চাষের আওতায় নিয়ে আসার জন্য জমি হতে বালি সরিয়ে দিয়ে চাষের আওতায় নিয়ে এসেছেন প্রায় ২ একর ফসলী জমি। এখন এইসব জমিতে কৃষক আমন ও বোরো মৌসুমে ধান চাষ করেন। পাহাড়ি পাদদেশের পতিত জমিতে পরীক্ষামূলক সবজি চাষ করে অন্য কৃষকদেরকেও সবজি চাষ করার ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এর ফলে আরো ৫ জন কৃষক পাহাড়ি পাদদেশের পতিত জমিতে সবজি চাষ শুরু করেছেন।

ইন্দ্রা তৈরি
এই গ্রামের অধিবাসীরা ছড়ার বালি খুড়ে খাবার পানি সংগ্রহ করেন সারাবছর। কিন্তু বর্ষাকালে কিছুক্ষণ পর পর পাহাড়ি ঢল নামলে খাবার পানির সংকট দেখা দেয়। তাই এই সমস্যা সমাধানকল্পে নিজেরাই বালি পাথর সংগ্রহ করে রিংস্লাব তৈরি করে দুটি ইন্দ্রা স্থাপন করেন। এক্ষেত্রে বারসিক তাদেরকে রিংস্লাব তৈরির ফর্মা সহযোগিতা করেছে। এর ফলে জনগোষ্ঠী কেবল বর্ষাকালে নয় বরং বছরব্যাপী পানিয় জলের সুবিধা ভোগ করছেন।

স্যানিটেশন তৈরি
স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন ব্যবহারের ক্ষেত্রে জনসচেতনতা তৈরির জন্য বিনা পারিশ্রমিক ছাড়াই ৪টি পরিবারকে স্যানিটেশন তৈরির রিংস্লাব তৈরি করে দিয়েছেন এবং ২টি পরিবারকে ল্যাট্রিন স্থাপন করে দিয়েছেন। এর ফলে উপকৃত পরিবারগুলো স্বল্প খরচে স্যানিটেশন তৈরি করার সুবিধা পেয়েছে এবং স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন ব্যবহার করতে পারছে।

IMG_20170418_172750

খেঁজুর বনায়ন
সকাল হতে না হতেই একসময় শীতের সকালে খেঁজুরের রস বিক্রেতার হাকডাক শুনা যেতো। বর্তমানে খেঁজুরের গাছ কমে গেছে। তাই খেঁজুরের রস খাওয়া হয়ে ওঠেনা অধিকাংশ গ্রামের মানুষের। তাছাড়া খেজুরের পাতার পাটি ও পাখাও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। তাই খেঁজুরের গাছ সহজলভ্য করতে রংছাতি ইউনিয়নের সম্মুখ হতে সন্যাসীপাড়া বরাবর চলে যাওয়া প্রায় দেড় কি.মি. রাস্তায় তারা খেঁজুর বীজ রোপণ করেছেন।

পরস্পরের চুল কাটা
বাজার ছাড়া ছেলেদের চুল কাটার বিকল্প কোন সুযোগ নেই। আর গ্রাম হতে বাজারের দূরত্ব প্রায় ৩ কিঃমিঃ। তাছাড়া চুল কাটা বাবদ খরচ পড়ে জনপ্রতি ৩০-৩৫ টাকা। তাই চুল কাটার খরচ কমাতে ও বাজারের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে তারা পরস্পর পরস্পরের চুল ছেটে দেন নির্দিষ্ট একটি দিনে। এর ফলে তাদের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও আন্তরিক সম্পর্ক আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।

সমাজের জন্য প্লেইট ক্রয়
এই এলাকার গারো ও হাজং আদিবাসী সমাজে এখনো কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে খাবার খাওয়ার জন্য প্লেইটের বিকল্প হিসেবে কলার পাতা বা কলা গাছের খোলস ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু বর্তমানে পাহাড়ে ও গ্রামেও কলার গাছ দিন দিন কমে যাওয়াতে কলার পাতা ও কলা গাছের খোলস সংগ্রহ করা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। তাই এই সমস্যার সমাধানকল্পে তারা ৭২টি প্লেইট নিজেদের প্রতিমাসে স্বল্প পরিমাণে জমানো সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে ক্রয় করেছেন। এর ফলে উপকৃত হচ্ছে পুরো সমাজের মানুষ।

Photo0935

ফুটবল খেলার আয়োজন
এলাকায় বিদ্যূৎ না থাকাতে টেলিভিশ দেখার সুযোগ নেই এলাকার জনগোষ্ঠীর। তাই যুবদের মাদক সহ অন্যান্য অনৈতিক কার্যকলাপ থেকে দূরে রাখার জন্য প্রতি বিকেলবেলা ফুটবল খেলার আয়োজন করে থাকেন। খেলাধূলা শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য নয় মাঝে মাঝে মেয়েদের জন্যও ফুটবল খেলার আয়োজন করে থাকেন। এতে যুবকদের পাশাপাশি এলাকার মানুষও বিনোদন পাচ্ছেন। ফুটবলের পাশাপাশি তারা ভলিবল, ষোলগুনি, দাবা, লুডু, মার্বেল, মির, মইলা প্রভৃতি খেলাধূলা করে থাকেন। এভাবে দেশীয় গ্রামীণ খেলা বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রেও কিছুটা হলেও তারা ভূমিকা রাখছেন।

এছাড়াও তারা তিন (গারো, হাজং ও মুসলিম) সম্প্রদায়ে সামাজিক ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানগুলোতেও শ্রম দিয়ে সহযোগিতা করে চলেছেন এবং রাস্তা পাড়াপাড়ের জন্য ছোট ছোট বাশেঁর ব্রীজ, কালভার্টের পাশে মাটি ভরাট করার কাজগুলোও তারা করে চলেছেন। তাদের এই উদ্যোগুলো সুষ্ঠু যুব সমাজ গড়ে তোলাতে অনেক ভূমিকা রাখবে বলে এলাকাবাসীর ধারণা।

happy wheels 2

Comments