হারিয়ে যাচ্ছে ধানকেন্দ্রিক লোকাচার
সাতক্ষীরা থেকে সাঈদুর রহমান
“ও ধান ভানিরে ঢেকিতে পাড় দিয়া ঢেঁকি নাচে আমি নাচি হেলিয়া দুলিয়া।” গ্রাম বাংলার বৌ ঝিদের ঢেকির তালে তালে ধান চাল ভাঙার বাস্তব চিত্র ফুটে উঠে গানটির মাধ্যমে। এক সময় এ সকল গানের সুর আর ঢেকির তালে তালে গমগম করতো বাংলার গ্রামগুলো। এ চিরায়ত দৃশ্য আজ এতটাই অপ্রচলিত হয়ে উঠেছে যে, শহরের মানুষ এমনকি গ্রামের মানুষও আজ ভুলতে বসেছে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্যের অংশ ঢেঁকির কথা। আজকাল গ্রামের বাড়িতে ঢেঁকি দেখা যায় না বললেই চলে। অথচ একসময় ঢেঁকি ছাড়া গ্রামের বাড়ির কথাই ভাবা যেতো না। ধান ভাঙানো, ডাল ভাঙানো, চাউলের গুঁড়া কুটা, হলুদ, ঝাল, বরুই ইত্যাদি গুঁড়া করতে প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে ঢেকি ছিল। বর্তমানে মিলের প্রচলন বেশি হওয়ার এ সকল ঢেঁকির প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। যার কারণে এ সকল ঢেঁকি আর খুব একটা দেখা যায় না। এভাবেই হারিয়ে যেতে শুরু করেছে চিরায়ত বাংলার এ নিদর্শন।
“বাড়িতে জামাই আয়িছে তাই গুড়– কুটতি আইছি, কুড়– দিয়ে পিঠি বাইতি হবে।” কথাগুলো বলছিলেন দামার পোতা গ্রামের গৃহিনী রেহেনা খাতুন। তিনি চাউলের গুঁড়া কুটতে এসেছেন পাশ্ববর্তী বাগডাঙ্গী গ্রামে। গ্রামে ঢেকি না থাকায়, বাড়িতে জামাই আসার কারণেই মূলত তিনি পার্শ্ববতী গ্রামে চাউলের গুঁড়া কুটতে গিয়েছিলেন। শুধু রেহেনা খাতুন নয় বাগডাক্সগী গ্রামসহ পাশ্ববর্তী দামার পোতা গ্রামের আরো অনেকে চাউলের গুঁড়া কুটতে আসে বাগডাঙ্গার পূর্ব পাড়ায় যৌথ উদ্যোগে স্থাপিত এ ঢেঁকিটিতে।
ঢেঁকি সম্পর্কে জানতে চাইলে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্য রক্ষা টিমের সদস্য মো. আব্দুল্লাহ বলেন, “বাংলাদেশের গ্রামীণ সংস্কৃতির সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে নবান্ন উৎসব, আর নবান্ন মানেই পিঠা পুলির ধুম। আর এসব কিছুর মূলে রয়েছে বাঙালির ঐতিহ্য ঢেঁকি। গ্রামীণ সংস্কৃতিতে ঢেঁকিতে চাউল গুড়া করা বা ঢেঁকি ছাটা চাউল তৈরির দৃশ্য অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। যদিও এর পরিসর এখন সীমিত হয়ে এসেছে।” তিনি আরও বলেন, “তবুও এখনো ঢেঁকিকে কেন্দ্র করে শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার এক ধরনের আমেজ বিরাজ করে। তাই নতুন ধান, ঢেঁকি, পিঠা পুলি এ সকল বাঙালি ঐতিহ্য রক্ষা করতে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।” তবে ঢেকি ছাটা চাউলের কদর কিন্তু এখনও রয়েছে। এ চাউলে প্রচুর ভিটামিন থাকে। যে কারণে এ চাউলের চাহিদাও রয়েছে।
সব কিছুর সাথেই মিশে ছিল ঢেঁকির এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। শুধু তাই নয় বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতিতেও ঢেঁকি দখল করেছিল এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান। জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে উপন্যাসে আমরা তারই চিত্র দেখতে পাই, যখন মকবুল বুড়োর তিন বউ ঢেঁকিতে ধান ভানে কিম্বা আম্বিয়া সারারাত জেগে ঢেঁকিতে ধান ভানে তারপর সকাল বেলা বাড়িতে এসে স্নান করে বিশ্রাম নেয়।
ঢেঁকি কেন্দ্রিক পিঠা উৎসব ছাড়াও নিকট অতীতেও গ্রামে চলতো নানা ধরনের পিঠা পুলির উৎসব। বাড়িতে বাড়িতে আত্মীয়স্বজনের নিমন্ত্রণ এবং জামাই মেয়ে নিয়ে এসে তাদের নানা রকম পিঠাপুলি দিয়ে আপ্যায়নসহ নানা ধরণের পূজা পার্বণ। একইসাথে গ্রাম বাংলায় ছিল নানা প্রকার ধান কেন্দ্রিক লোকাচার। নতুন ধান্যে হত নবান্ন। বাড়িতে বাড়িতে চলত আত্মীয় স্বজনের পিঠা পুলির নিমন্ত্রণ।
ধান কেন্দ্রিক লোকাচার সম্পর্কে দামার পোতা গ্রামের বাসিন্দা তৌহিদুজ্জামান বলেন, “আগে ধান কাটার আগে পশু জবাই করা হতো, যাতে ধানের বালা মসিমত না হয়। ধানের শীষ আসার আগে করা হতো লক্ষ্মী পূজা। গ্রামের মানুষ তাদের বিভন্ন প্রকার বিপদ আপাদে পড়লে বিপদ থেকে উদ্ধার হওয়ার জন্য আল্লার নামে নতুন চাউলের খির মানত করত।” তিনি জানান, গ্রামের কোন গৃহস্থের বাড়িতে গরুর বাছুল হলে, প্রথম যে দিন তারা দুধ দোহন করেন সেই দুধ আর আতপ চাউল দিয়ে খির (পায়েস/সিন্নি ) রান্না করে পাড়ার ছেলে মেয়েদের ডেকে আল্লার নামে বিতরণ করতেন। এ বিতরণ শেষ হলে তারা একসাথে জোরে ও আল্লা ও আল্লা বলে চিৎকার করে তারপর খাওয়া শুরু করতো।
শুধু ধান কাটার পর নয়, ধান কাটার আগেও চলত নানা লোকাচার। আশ্বিন মাস শেষে যে দিন কার্তিক মাস শুরু হতো সেদিনের রাতে ধান ক্ষেতে গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের কৃষকরা ধন সম্পদের দেবী মা লক্ষ্মীর পূজা করতেন, ভোগ দিতেন এবং ‘আশ্বিন গিয়ে কার্তিক পড়ল মা লক্ষ্মী গর্ভে পড়ল, ধান সাধ খাও ভাত খাও গো হো’ এই গান গাইতেন। ধান ক্ষেতে আলো জ্বালানোর মাধ্যমে মা লক্ষ্মীর বিয়ে দেওয়া হতো। বিশ্বাস করা হতো যে, মা লক্ষ্মী খুশি হয়ে তাদের অধিক ধান দিবেন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে যাচ্ছে এ সকল ধানকেন্দ্রিক লোকাচার।
তবে ঢেঁকিসহ গ্রাম বাংলার ধানকেন্দ্রিক লোকাচারগুলো কেবল ইতিহাসে পাওয়া যায়। সময়ে পরিক্রমায় হারিয়ে গেছে এসব ঐতিহ্যবাহী লোকজ সংস্কৃতি। নতুন প্রজন্মের কাছে এই লোকাচার পরিচিত করার জন্য এসব লোকাচার এবং ঢেঁকি কেন্দ্রিক গ্রামীণ চর্চাগুলো বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন। এজন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।