শিমবৈচিত্র্য : প্রায়োগিক কৃষি গবেষণা
ঢাকা থেকে এবিএম তৌহিদুল আলম, শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে পার্থ সারথী পাল, রামেশ্বরপুর, নেত্রকোণা থেকে রোখসানা রুমি এবং নাচোল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে অনিতা বর্মণ
সারসংক্ষেপ
বাংলাদেশের পৃথক তিনটি কৃষি-পরিবেশ অঞ্চল যেমন পুরাতন ব্রহ্মপুত্র পললপ্লাবন ভূমির অন্তর্গত নেত্রকোণা, গাঙ্গেয় জোয়ার প্লাবনভূমি কৃষি-পরিবেশের সাতক্ষীরা ও উচ্চ বরেন্দ্র ভূমির অধীন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাসহ মোট ৩ জেলার ৮টি গ্রামের ৮ জন কৃষাণী বিগত খরিফ-২ মৌসুৃমে সর্বমোট ৩৪ ধরনের শিম পরীক্ষামূলক চাষ করেন। বাহ্যিক ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য যেমন পুষ্পায়ন, ফলধারণের সময়কাল, রোগবালাই প্রতিরোধ ক্ষমতা, রান্নার সময়কাল, স্বাদও বাজারমূল্য ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে কোরালিয়া শিম, কাইক্যা শিম, পুঁটি শিম, কামরাঙ্গা শিম, ঘিকাঞ্চন শিম, আলিকাঞ্চন শিম, জামাইকলুই শিম, কার্তিকা শিম এবং করমজা শিম কৃষাণীরা পছন্দ করেন। পরীক্ষণ থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বলা যায়, আমাদের দেশের নানা প্রান্তের গ্রামাঞ্চলে এখনও অনেক ধরনের শিম বিদ্যমান যা ভিন্ন ভিন্ন কৃষি-পরিবেশে চাষ উপযোগিও লাভজনকভাবে চাষ করা সম্ভব।
সূচনা
বাংলাদেশের অতি জনপ্রিয় ও পুষ্টিকর সবজি শিম একটি আলোক সংবেদনশীল সবজি যা সাধারণত শীতকালে চাষ করা হয়। তবে বারোমাসী শিম সারাবছরই চাষ করা যায়। গ্রীষ্মকালে দিনের দৈর্ঘ্য বেশি হওয়ায় শিমের চাষ হয় না। ছোট দিনে শিমগাছে ফুল আসতে শুরু করে। গ্রামাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই শিমের চাষ হয়। শিম গাছ শিকড়ের সাহায্যে বাতাস থেকে নাইট্রোজেন আবদ্ধ করে মাটিকে উর্বর করে তোলে। বাংলাদেশে শিমের যে জাত রয়েছে সেগুলোতে সাধারণত অক্টোবর মাসের আগে এর ফুল আসে না। (‘গ্রীষ্মকালের চাষেও চাহিদা মেটাবে শিম-টমেটো’, ড. শহীদুল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক, উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা নিউজ২৪.কম, জুলাই ১২, ২০১৩)। বাংলাদেশের প্রতিটি কৃষিপরিবেশ অঞ্চলে বিভিন্ন ফেনোটাইপের নানা বৈশিষ্ট্যের হরেক রকমের শিম রয়েছে। আবার একই শিমই কখনো কখনো বিভিন্ন এলাকায় ভিন্ন নামেও পরিচিত লাভ করে। শিমের যেহেতু আগাম, মাঝারি ও নাবি জাত আছে তাই জাতের সঠিক তথ্য জেনে চাষ না করলে ভালো ফলন পাওয়া যায় না। বিভিন্ন ফেনোটাইপিক বৈশিষ্ট্যের এই শিমগুলো নানা কারণে বিলুপ্তির সম্মুখীন। কিন্তু জাত গবেষণা ও শিমজাত উন্নয়নের জন্য এইগুলো ভবিষ্যতেও প্রয়োজন রয়েছে।
উপকরণও গবেষণা পদ্ধতি
বিগত ২০১৬ সালের খরিফ-২ মৌসুমে শিমবৈচিত্র্য প্রায়োগিক গবেষণা কার্যক্রমটি পরিচালিত হয় নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার ভূগিয়া গ্রাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলার পুকুরিয়া পাড়া, টিকইল ও বরেন্দা গ্রাম এবং সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার আড়পাঙ্গাসিয়া, হাটচালা, হায়বাতপুর ও বড়কুপোট গ্রামে। মোট ৩৪ ধরনের শিম যেমন কার্তিকা শিম, ছোট কার্তিকা শিম, বড় কার্তিকা শিম, সবুজ কার্তিকা শিম, জলকার্তিকা শিম, নলকোষ শিম, ছোট নলকোষ শিম, বড় নলকোষ শিম, সাদা নলকোষ শিম, করমজা শিম, সবুজ করমজা শিম, কামরাঙ্গা শিম, তোড়াশিম, কাকশেল শিশ, জামাইকলুই শিম, ঘিকাঞ্চন শিম, আলিকাঞ্চন শিম, আলতাবাদ শিম, দুধশিম, গুতুমশিম, চিকড়াশিম, পুঁটিশিম, খৈইলা শিম, বউসুন্দরী শিম, কাইক্যা শিম, কুটে শিম, সবুজপাতা শিম, চামুয়া শিম, কোরালিয়া শিম, লালশিম শিম, তোড়াশিম, রেশমিলন শিম, সবুজ ঝুমকা শিম ও দুপা শিম এই প্রায়োগিক গবেষণায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়। প্রতিটি বসতভিটায় কৃষাণীদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ও জৈব পদ্ধতির চাষাবাদে পরিচালিত এই পরীক্ষণে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ১.৫ বর্গফুট আকৃতির পিট তৈরি করে তৃতীয় সপ্তাহে প্রতিটি পিটে ৬ থেকে ৯টি বীজ বপন করা হয়। ৫-৮ দিনের মধ্যে অংকুরোদগদের পর সেখান থেকে প্রতিটি পিটে ২টি সবল চারা রেখে বাকিগুলো নষ্ট করে ফেলা হয়। পরীক্ষণে অন্তর্ভূক্ত প্রতিটি শিমের পাক্ষিকভিত্তিতে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। গবেষণার সাথে যুক্ত কৃষাণী ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠির মতামতকে তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণের ভিত্তি হিসাবে ধরা হয়।
ফলাফল পর্যালোচনা
পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ঘিকাঞ্চন এবং আলিকাঞ্চন জাত দু’টিতে সবার প্রথমে জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে ফুল এসেছে। এরপর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ফুল এসেছে জামাইকলুই শিমে। কাকশেল, জলকার্তিকা, নলকোষ, সবুজকার্তিকা, ছোট নলকোষ, কামরাঙা, কার্তিকা, তোড়া শীমে অক্টোবর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ফুল এসেছে। তোড়া শিম, সবুজপাতা, করমোজা, সবুজ করমজা, আলতাবাদ, সাদা দুধশীম এবং সাদা নলকোষ শিমগুলো খুবই নাবি যাদের ডিসেম্বর মাসের প্রথম থেকে দ্বিতীয় সপ্তাহে ফুল এসেছে। ফুল আসার সময় বিবেচনা করলে এটা স্পষ্টত প্রতীয়মান যে, ঘিকাঞ্চন, আলিকাঞ্চন, জামাইকলুই শিমগুলো বর্ষাকালীন এবং কাকশেল, জলকার্তিকা, নলকোষ সবুজ, কার্তিকা, ছোট নলকোষ, কামরাঙ্গা, তোড়া শীম, বড় নলকোষ, সবুজ করমজা, আলতাবাদ, সাদা দুধশীম সাদা নলকোষ, করমজা শীতকালীন শিম হিসাবে বেশি উপযোগী। একই সময়ে বীজ বপন করলেও ঘিকাঞ্চন, আলিকাঞ্চন এবং জামাইকলুই জাতগুলো ছাড়া অন্য সব শিমে বর্ষার পর অর্থাৎ অক্টোবরের মাসের পর ফুল এসেছে, এগুলো মূলত শীতকালীন শিম বলা যায়। কৃষাণীদের দেওয়া তথ্যমতে, ঘিকাঞ্চন এবং আলিকাঞ্চন শিম শীতকালেও চাষ করা যাবে এবং উপকূলীয় এলাকায় এই দু’টি শিমের উৎপাদন ভালো হবে বলে তারা মতামত দেন। গবেষণায় দেখা গেছে, সব শিমেই স্বল্প থেকে মাঝারি মাত্রায় জাব পোকার আক্রমণ হয় যা সাবান-পানি, মেহগনি ফলের রস স্প্রে করে এবং বাসি ছাই ছিটিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি শিমের নামকরণের সাথে এর উৎপাদন সময়, ফলধারণ, ফলের আকার, বর্ণ বা অন্য কোনো বৈশিষ্ট্যের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। যেমন তোড়া শিম ও সবুজ ঝুমকা শিমের ফলধারণ বৈশিষ্ট্যের সাথে ফুলের তোড়া ও ঝুমকা (কানের দুল)’র মিল রয়েছে। তেমনি কামরাঙা শিমের দৈহিক আকৃতিতে কামরাঙা ফলের সাথে সাদৃশ্য দেখা যায়। আবার অঞ্চলভিত্তিক শিমের জনপ্রিয়তায়ও ভিন্নতা দেখা গেছে। যেমন কাইক্যা শিম ও পুঁটি শিম নেত্রকোণা অঞ্চলে খুবই জনপ্রিয়। তেমনি কোরালিয়া শিম বরেন্দ্র এলাকায় বেশি পছন্দের কেননা এই শিম স্বাদে খানিকটা মিষ্টি ও সহজে সেদ্ধ হয়। উৎপাদনের বিবেচনায় কামরাঙ্গা, ঘিকাঞ্চন, আলিকাঞ্চন, জামাইকলুই, কার্তিকা এবং করমজা শিমগুলো থেকে ভালো ফলন পাওয়া যায়।
উপসংহার
ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, বিভিন্ন শিমে বিভিন্ন ধরনের ফেনোটাইপিক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান যা মানুষের পছন্দ ও বাজারমূল্যের নির্ধারক। সর্বাধিক পছন্দের জাতগুলো যেমন অধিকতর গবেষণার দাবি রাখে তেমনি এই শিমগুলো বিভিন্ন এলাকায় চাষের জন্য সহজলভ্য হলে দেশে শিমবৈচিত্র্যও বাড়বে।