একটি পাড়া মেলা ও নারীর লোকায়ত চর্চা
নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা
মাঘ মাসের কনকনে শীতের সকালে উঠান বাড়ি পরিষ্কার করার কাজটি করার আগেই উনুনে আগুন ধরায় কৃষাণীরা। ঠান্ডায় জমে থাকা হাতগুলো গরম করা জন্য। বিশ্বনাথপুর গ্রামে শীত বাড়ার সাথে সাথে প্রায় প্রতিটি পরিবারের নারীরা এ কাজটি করছিলেন। কিন্তু আজ এক ভিন্ন চিত্র, কোথায় ঠান্ডা কোথায় উনুনের আগুনে হাত গরম করার চিন্তা সবাই কুয়াশায় পা ভিজিয়ে বাড়ির চারপাশে খুব নিরবে নিজেদের মতো লতাপাতা সংগ্রহ ব্যস্ত। নেত্রকোনা জেলা আমতলা ইউনিয়নের বিশ্বনাথপুর গ্রামের শীতের সকালের চিরাচরিত রীতিগুলো বদলিয়ে দিয়ে কৃষাণীদের এ ব্যস্ততার কারণ আজ গ্রামে অচাষকৃত উদ্ভিদের পাড়া মেলা।
২০ জানুয়ারি বিশ্বনাথপুর কৃষাণী সংগঠনের উদ্যোগে ও বারসিক’র সহযোগিতায় কৃষিতথ্য কেন্দ্র অচাষকৃত উদ্ভিদের পাড়া মেলার আয়োজন করা হয়। পাড়া মেলায় অংশ নেয় আমতলা ইউনিয়নে তিনটি গ্রাম বিশ্বনাথপুর, গাছগড়িয়া, পাঁচকাহনীয়রা গ্রামের কৃষাণীরা। ২০ থেকে ৭০ বছর বয়সি প্রবীণ ব্যক্তিরা অংশ নেয় মেলায়। ঘর সংসারের কাজে সকাল সন্ধ্যা ব্যস্ত থাকা নারীরা যেন হঠাৎ স্বাধীনতা পেয়েছেন। নিজের ইচ্ছে মতো অনুষ্ঠানের আয়োজন করার দায়িত্ব পেয়ে কৃষাণীরা সবাই খুশি। পুরুষদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে কৃষাণীদের নিয়ে ছোট পরিসরে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গাটিকে মজবুত করে তুলে।
একটি ছোট উদ্যোগ যেন দীর্ঘ প্রবীণ ও নবীনের মধ্যে থাকা বয়স ও সামাজিক দুরত্বকে দূর করে এক সীমানায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ভিন্ন ধর্মী উদ্যোগকে উৎসাহিত করতে মেলায় অংশ নেয় বারসিক কর্মকর্তা শংকর ¤্রং, সুমন তালুকদার, খাদিজা আক্তার লিটা। নিজেদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা অচাষকৃত নানা ধরনে লতা, পাতা, ফুল, বীজ, শিকর, কুলা, ডালায় সাজিয়ে মেলায় উপস্থিত হন কৃষাণীরা। কৃষাণীরা একে একে নিজেদের স্টলে সাজানো বিভিন্ন ধরনের খাদ্য ও উদ্ভিদ ও ঔষধ গাছগুলো প্রদর্শন করেন। কৃষাণীরা স্টলের আনা প্রতিটি লতা, পাতার নাম ও ্উপকারিতা ও কি কাজে ব্যবহার হয় তার বর্ণনা দেন। গরুনা, পালই, হাতিরসুর, নাকফুল, পাগলাপালই, কলমী, গিমাই, এলঞ্চি, পাতা বাহার, থানকুনি, দলকলস, বরুনা, দুধ কচু, তেলাকুইচ্ছা, লজ্জাবতি, বউটুনি, মরিচ ফুল, নিমপাতা, কাটা খুইরা ঘৃতিকাঞ্চন, আদা বাউস, বিটি বেগুন, অর্জুনের ছাল, বিষ ঝাড়–নি, কুমারি ডগা, ঢেঁকি শাক, চালতা পাতা, মনিরাজ, মটকিলা ইত্যাদি ৬৭টি জাতের খাদ্য ও ঔষধি উদ্ভিদ প্রদর্শন করেন কৃষাণীরা।
এগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের গ্রাম অঞ্চলের নারীরা প্রাকৃতিভাবে জন্মানু অবহেলায় পরে থাকা উদ্ভিদের ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবারের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও বাজার নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনায় তাদের ভূমিকা ফুটে উঠে তাদের বর্ণনায়, যা আমাদের দেশের নারীদের ব্যয় সাশ্রয়ী অর্থনীতিতে নিরব ভূমিকা বড় উদাহরণ।
মেলায় ১ম স্থান অধিকার করেন কৃষাণী লিজা বেগম ৬৭টি অচাষকৃত উদ্ভিদ প্রদর্শন করে, ২য় স্থান পারভীন আক্তার (৫৭টি), ৩য় স্থান অধিকার করেন কৃষাণী সাবানা বেগম ৫২টি উদ্ভিদ প্রদর্শন করে। কৃষাণীদের এ ধরনের আয়োজনকে উৎসাহিত করতে প্রতিটি স্টলের কৃষাণীদের হাতে পুরষ্কার হিসেবে ভিন্ন ধরনের কৃষি উপকরণ তুলে দেন মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রবীণ কৃষাণী নুরজাহান বেগম ও সভাপ্রধান পারভীন বেগম। পুরষ্কার হাতে নিয়ে মেলায় অংশগ্রহণকারী কৃষাণী প্রিয়া বেগম বলেন, ‘মেলায় অংশগ্রহণ করে অনেক ধরনের গাছগাছালি উপকারিতা জানতে পারলাম, যা আমাদের কাজে লাগবো।’
মেলায় অংশগ্রহণকারী বারসিক কর্মকর্তা শংকর ¤্রং মেলা শেষ পর্যায়ে মেলাকে সফল করে তুলতে মেলায় উপস্থাপিত সকল ধরনে খাদ্য, উদ্ভিদ, ঔষধি গাছ সংগ্রহে সকলে মিলিতভাবে কাজ করা ও সুন্দর এ আয়োজনের জন্য সাবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে মেলার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
আধুনিকতার ছোঁয়ায় আমাদের অনেক গ্রামের সহজ সরল প্রকৃতি নির্ভর জীবন জীবিকার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বেড়েছে বাজার নির্ভরশীলতা । বিশেষ করে বাজার নির্ভরশীল খাদ্য ব্যবস্থা আমাদেরকে ঠেলে দিচ্ছে নতুন নতুন রোগের দিকে। যার ফলে পরিবারের আয়ের একটি বড় অংশ চলে যায় চিকিৎসার ক্ষেত্রে। এমনি পরিস্থিতিতে এখনো গ্রাম বাংলার অনেক প্রান্তিক নারীরা নিজেদের চারপাশের পরিবেশ ও পরিবারের প্রবীণ ব্যক্তিদের চর্চা, জ্ঞানকে পুঁজি করে নিজেদের পরিবারের জন্য নিরাপদ খাদ্য, চিকিৎসার সহজ সরল সমাধান খুঁজে নেন। কারণ আমাদের প্রকৃতিতে রয়েছে আমাদের নিরাপদ খাদ্য ভান্ডার ও নানামূখী চিকিৎসার সহজ সমাধান।
আসুন আমরা সবাই মিলিতভাবে প্রকৃতির এ সম্পদকে রক্ষা করি। শ্রদ্ধা জানাই ও উৎসাহিত করি সেই সব নারীদের যারা নিজেদের চর্চার মধ্য দিয়ে আমাদের এ লোকায়ত জ্ঞনচর্চাকে এ আধুনিকতার ভিড়ে হারিয়ে যেতে দেয়নি ।