মহাঢেউ নদী এবং ধান চাষ
গুঞ্জন রেমা ও খায়রুল ইসলাম অপু
বাংলাদেশের বুক চিরে বয়ে চলেছে ভারতের মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমে আসা মহাঢেউ নদী। কলমাকান্দা উপজেলার রংছাতি ইউনিয়নের সীমান্তঘেঁষা পাতলাবন, সন্যাসীপাড়া গ্রাম দিয়ে প্রবেশ করে একে বেকে অনেক দূর পথ পারি দিয়ে মহেশখলা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। নদীর দুই পাড় বালি পাথরসহ অন্যান্য খনিজ পদার্থে আবৃত। এই বালির কারণে চৈত্র মাসে দুই পাশে থাকা গ্রামগুলোতে পানির তীব্র সংকট তৈরি হয়। যার কারণে ঐসব এলাকায় কেউ ধান ফলাতে পারেন না। যদি কেউ ধান চাষ করতে চান তবে তাদেরকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয় সেচের পানি যোগানের জন্য। তারপরও আশানুরূপ ফলন যে পাবেন তার কোন নিশ্চয়তা নেই! এমনও দেখা যায় চৈত্র মাসে এই নদীর দুই পাশে থাকা পাতলাবন, বরুয়োকোণা, মৌতলা ও সন্যাসীপাড়া গ্রামের বাঁশঝাড়গুলো পর্যন্ত মরে যায়। সেই সাথে দেখা দেয় গো খাদ্যের প্রচন্ড সংকটও!
এই নদীর নাব্যতা অনেক কম হওয়ায় শীতকালে নদীতে পানিই থাকে না। নদীর নাব্যতা কমলেও এর প্রস্থ কিন্তু দিনকে দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। এই নদীর নাব্যতাকে বৃদ্ধি করা এবং একে বাঁচানোর জন্য কোন উদ্যোগ নেই। তাই দেখা যায় শুকনো মৌসুমে এই নদীতে পানি থাকে না বিধায় ভালো পরিমাণের জায়গা অবহেলায় পড়ে থাকে। এছাড়া এ নদীতে পানি না থাকায় কৃষকরা নদীর পার্শবর্তী জমিগুলো ফসল ফলাতে পারেন না। তাই কৃষকরা বিকল্প চিন্তা করে দেখেছেন যে, নদী শুকিয়ে যাওয়ার পর যে জমিগুলো পড়ে থাকে সেই জমিগুলোতে ফসল ফলানো যেতে পারে। এতে করে সেচ দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না। নদীর বুকে যেসব পাথর ও বালি রয়েছে শুধু সেগুলোকে সরালেই ধানসহ অন্যান্য ফসল ফলানো যেতে পারে। বালি ও পাথর ছাড়াও নদীর বুকে দেড় থেকে দুই ফুট গভীরে রয়েছে এটেল মাটি। এই এটেল মাটির অস্তিত্বই কৃষকদের আশা জাগিয়েছে। কারণ তারা মনে করছেন বালি ও পাথর সরিয়ে এই এটেল মাটিতেই তারা ধানসহ অন্যান্য ফসল ফলাতে পারেন। মূলত এই আশা থেকেই বালি ও পাথর সরিয়ে নদীর বুকে ধান চাষের উদ্যোগ নিয়েছেন কৃষকরা।
এই নদীর বুকে বালি ও পাথর সরিয়ে প্রথমবারের মত রোবো ধান চাষ করার উদ্যোগ নেন আবুল কাশেম। তিনিই প্রথম বালি খুড়ে এটেল মাটিতে ধান চাষ করেন। তার দেখাদেখিতে মো. নবী হোসেনও ধান চাষ করেন। এই প্রসঙ্গে আবুল কাশেম বলেন, “আমি সুসং দূর্গাপুর গিয়া দেকসিলাম স্বমেশ্বরী গাঙ্গের মইদ্যে দান লাগাইসে ও বালাই অইসে হেইদা দেইখা আমিও এই হানে দান লাগাইতে চাইলাম।” তিনি গতবছর এই আনুমানিক ৮ কাঠা জমিতে ধান রোপণ করে ৩২ মণ ধান পেয়েছেন। গত বছরের অভিজ্ঞতা ও ভালো ফলনের কারণে তিনি এ বছর আরো একটু বেশি করে ধান রোপণ করছেন। নিজস্ব কোন জমি না থাকায় নদীর তীরে জেগে ওঠা চরের জমিতে তিনি ধান আবাদ করে আসছেন।এতে করে তার ৬-৭ মাসের খোরাকী চলে। তবে ভালো ফলনের জন্য তাকে খুবই পরিশ্রম করতে হয়। কারণ দেড় দুই ফুট বালি পাথর সরাতে হয়। তারপর জমি সমান করে হালচাষ করতে হয়। শ্রমিক নিয়োগ করে যদি বালি ও পাথর সরানো হয় তাহলে উৎপাদিত ফসলের কোন লাভ থাকে না। তাই নিজেই এসব পরিশ্রমসাধ্য কাজ করছেন। তবে সুবিধাও পাচ্ছেন এই জমিতে ধান চাষ করার ক্ষেত্রে। কেননা এই জমিতে ঘাস জন্মে না বললেই চলে। এছাড়া পানির সংকটও যেমন নেই তেমনিভাবেপোকার আক্রমণও কম হয়।
আবুল কাশেমের সাফল্যে অনেকে অনুপ্রাণীত হয়েছেন। তার দেখাদেখিতে এবছর বেশ কয়েকজন কৃষক মহাদেও এর বুকে ধান চাষ করছেন। যারা গত বছর ফসল ফলিয়েছেন তারা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে জানিয়েছেন যে, আবাদী জমিতে যে পরিমাণ ধান হয় তার চেয়ে বেশি পরিমাণে এই নদীতে হয়। কিন্তু সমস্যা হল যদি কোন কারণে অসময়ে পাহাড়ি ঢল আসে তবে ধান পাওয়ার কোন আশা থাকে না। তাই এখানে ধান করাটা অনেকটা অনিশ্চিত। তাই তারা এমন ধানই সেখানে আবাদ করেছেন যে ধান আবাদ করলে তারা স্বল্প সময়ের মধ্যেই ঘরে তুলতে পারেন।
নদীর বুকে পড়ে থাকা অব্যবহৃত জমিগুলো কৃষকরা ব্যবহার করছেন খাদ্য উৎপাদনের জন্য। অথচ নদীকে খনন করলে পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত হবে বলে নদীর আশপাশের জমিগুলোতেই কৃষকরা ফসল ফলাতে পারতেন। কিন্তু নদীকে বাঁচানো বা খনন করার কোন উদ্যোগ না থাকায় কৃষকরা পানির অভাবে শুকিয়ে যাওয়া নদীতেই ধান চাষ করছেন! এর ফলে নদীর বুক খন্ড-বিখন্ড হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। যার কারণে পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে একসময় মহাদেও নদী একটি মৃত নদীতে রূপান্তরিত হবে। শুকনো মৌসুমে এই নদীকে আর আর নদী মনে হবে না; মনে হবে কোন আবাদী জমি বা ক্ষেত!