শুধুমাত্র দরকার একটু মিষ্টি পানি
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে মনিকা, চম্পা মল্লিক ও বিশ্বজিৎ মন্ডল
‘আমরা বাস করি একটা দ্বীপের মধ্যে। আমাদের গ্রামের নাম চকবারা। এটি শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের মধ্যে। এই ইউনিয়নের চারিদিকে খোলপেটুয়া নদী। বাইরের কোন উপজেলা বা ইউনিয়নের সাথে যোগাযোগ করতে গেলে নদী পার হতে হয়। চারদিকে নদী থাকায় এবং এলাকায় লবণ পানির চিংড়ি ঘের বেশি থাকায় এখানকার পানিতে লবণের মাত্রা একটু বেশি। লবণ থাকলেও তারই মধ্যে দিয়ে আমরা আমাদের গ্রামের কিছু পুকুর, খাল, ঘেরের মিষ্টি পানি রেখেছিলাম। কিন্তু ২০০৯ সালের আইলার পরে আমাদের সব আশা ভরসা ও সুখ সমৃদ্ধি নষ্ট হয়ে যায়। আইলার পর দীর্ঘদিন ধরে লবণ পানি বসতভিটায় থাকছে। যার প্রভাবে এলাকা থেকে সব ধরনের ফসল চাষ ও প্রাণবৈচিত্র্য কমে যায়। সেখান থেকে আমরা নানান ধরনের চেষ্টা করে চলেছি কিভাবে আগের সেই পরিবেশ ফিরিয়ে আনা যায়। কিন্তু বারবার আমাদের সব চেষ্টা ব্যর্থতায় পরিণত হচ্ছে। এলাকায় প্রতিবছরেই নানান ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়। যার প্রভাবে নদী ভেঙে বসতভিটায় লবণ পানি প্রবেশ। কোনমতেই লবণ পানি যেন আমাদের পিছু ছাড়ছে না। এলাকায় যদি মিষ্টি পানি হতো তাহলে আমরা এখানে সব কিছু করতে পারতাম। এখন আমাদের দরকার শুধূ একটু মিষ্টি পানি। তার জন্য সঠিক পরিকল্পনা হওয়া দরকার।’
উপরোক্ত কথাগুলো বলেছেন গাবুরা ইউনিয়নের চকবারা গ্রামের প্রবীণ কৃষক গোলাম বারী সরদার, কালাম গাজী, সাজিদা, রুনা আক্তার, হাবিবুল্লাহ ও ফতেমা বেগমরা। বারসিক’র চকবারা গ্রামে মাঠ পর্যবেক্ষণে শতবাড়িসহ বিভিন্ন বাড়ি পরিদর্শন ও এলাকার সমস্যা জানতে চাইলে উপরোক্ত কথাগুলো বলেছেন তারা।
কৃষাণী রুনা আক্তার বলেন, ‘২০০৯ সালের আইলার পরও অনেক দুর্যোগ হয়েছে, যা আমাদের অনেকটা পিছিয়ে দিয়েছে। এখন আমরা নানান ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। বসতভিটায় এখন বিভিন্ন ধরনের সবজি যেমন লালশাক, পালনশাক, মূলা, ওলকপি, বীটকপি, ঢেড়স,বববটি, পুইশাক, বেগুন, আলু, কচুরমুখী, কচু, তরুল, ঝিঙা, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, উচ্ছে, কুশি, শসা বিভিন্ন মসলা, বিভিন্ন ফলজ গাছ, পুকুর ও ঘেরে নানান ধরনের মাছ চাষ করছি। কিন্তু তা আগের তুলনায় কম হচ্ছে। শুধুমাত্র পানির জন্য আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। এখানে যেমন ফসল চাষের পানির সমস্যা তেমনি খাবার পানিরও সমস্যা। সব কিছুর মুল সমস্যা হলো সুপেয় পানি না থাকা।’
প্রবীণ কৃষক গোলাম বারী সরদার বলেন, ‘আমাদের পানির সমস্যা না থাকলে কোন সমস্যা থাকতো না। নিজেদের বসতভিটা যতটুকু আছে সেখানে বারোমাস সবজি চাষ এবং কিছু জায়গায় দুইবার ধান চাষ করাও সম্ভব। কিন্তু পানির জন্য তা হচ্ছে না। এখন আমরা অনেকে বসতভিটার পুকুর এবং কিছু বাড়িতে আবার টিউবওয়েল স্থাপন করে সবজি চাষ করছি। টিউবওয়েলের পানি খাওয়া না গেলেও তা দিয়ে আমাদের গৃহস্থালির কাজ এবং সবজি চাষে ব্যবহার করা যাচ্ছে। আমার মনে হয় এখানকার নিচের পানি ভালো হতে পারে কিন্তু এলাকায় ডিপ টিউবওয়েল কেউ পরীক্ষা করে দেখেনি। কারণ এটা পরীক্ষা করা অনেক ব্যববহুল।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এখানকার অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র। তাদের পক্ষে এই খরচ বহন করা কষ্টকর। তাই যদি কেউ বা কোন প্রতিষ্ঠান কোনভাবে আমাদের ডিপের পানি পরীক্ষা করতে সহায়তা করতো তাহলে ভালো হতো। এটা পরীক্ষা করে যদি ভালো ফলাফল হয় তাহলে এলাকার মানুষ আমরা একত্রিত হয়ে স্যালো স্থাপন করে নিতাম। যাতে করে আমরা বসতভিটায় ধান ও সবজি করতে পারতাম।’
বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল দুর্যোগপ্রবণ এলাকা হিসাবে পরিচিত। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি স্থান হলো সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার দ্বীপবেষ্টিত গাবুরা ইউনিয়ন। এখানকার বারসিন্দারা প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে মোকাবেলা করে টিকে থাকার চেষ্টা অব্যাহত আছে তাদের। তাদের ভাষ্য মতে, এলাকার রূপ পরিবর্তন একমাত্র ভূমিকা রাখতে পারে পানি। আর তা হলো মিষ্টি পানি। পানির মান ভালো হয় তা সব ভালো হয়।