‘বীজ জননী’ বীজের স্বার্বভৌমত্ব

নেত্রকোনা থেকে মো. আলমগীর

কৃষি, কৃষক দেশ,
কৃষকের নিয়ন্ত্রণে কৃষি থাকলে কৃষক বাঁচবে,
কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে,
সমৃদ্ধ হবে প্রাণবৈচিত্র্য,
রক্ষা পাবে প্রাকৃতিক সম্পদ,
পরিবেশ হবে দূষণমুক্ত এবং জীবনমান হবে সহজতর”

নিজের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, সম্পদ ও পারস্পরিক বিনিময়ের মাধ্যমে নিজেদের ভেতর গড়ে ওঠেছে এক সফলতার গল্প। যে গল্পের মানুষ হলেন কৃষানী ‘বীজ জননী’ কল্পনা আক্তার।
যতই দিন যাচ্ছে কৃষি যেন কৃষকের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে কৃিষর প্রধান উপকরণ বীজ, বীজ ও নারী, বীজ সংরক্ষণে নারী এই শব্দগুলো যেন নতুন প্রজন্মের কাছে এখন যেন রূপকথার মত। যুগ যুগ ধরে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এদেশের গ্রামীণ নারীরাই বৈচিত্র্যময় শস্য ফসলের বীজ রোপণ, বীজ উৎপাদন, বীজ সংরক্ষণ করে পারস্পারিক বীজ বিনিময়ের মাধ্যমে সকলের জন্য বৈচিত্র্যময় বীজের সহজল্য করেছে। কিন্তু বর্তমানে অধিক উৎপাদনের লোভে উফশী, হাইব্রিড ও জিএমও বীজের ব্যাপক প্রচারণা ও বাজার ব্যবস্থাপনার কাছে গ্রামীণ নারীদের নিজস্ব জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিন দিন হয়ে পড়েছে মূল্যহীন। কৃষকরা বীজসহ সকল কৃষি উপকরণের জন্য হয়ে পড়েছে বাজার নির্ভরশীল। এমনই অবস্থায় আটপাড়া উপজেলার মনসুরপুর গ্রামের একজন কৃষিাণী কল্পনা আক্তার গ্রামীণ কৃষাণীদেরকে স্থানীয় জাতের বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ, বীজ বর্ধন, বিনিময় এবং স্থানীয় জাতের বীজ রোপণে উদ্বুদ্ধকরণে গড়ে তুলেছেন ভিন্নধর্মী এক চিন্তার মুকুট ‘বীজ জননী’র। এই ‘বীজ জননী’ই এখন তার বিপথগামী সন্তানদের মধ্যে বীজ বিনিময় প্রথা ও পারস্পারিক আন্তঃসম্পর্ক উন্নয়নে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

কল্পনা আক্তার (৪৫+), স্বামী ও দুই ছেলে-মেয়ে এবং শাশুড়িকে নিয়ে পাঁচজনের সংসার। বসতভিটাসহ মাত্র ৪০ শতাংশ জমি কল্পনার একমাত্র সম্বল। কল্পনা আক্তার একজন বীজ উৎপাদক ও বীজ সংরক্ষণকারী। তিনি নিয়মিত বৈচিত্র্যময় শস্য ফসল চাষ ও বীজ উৎপাদন করে থাকেন। ২০১৮ সালে আটপাড়া উপলোয় কৃষি বিভাগ আয়োজিত একটি প্রশিক্ষণে বারসিক’র সম্পদ ব্যক্তি নাসরিন আক্তারের সাথে কল্পনা আক্তার’র আলাপ হয় এবং তিনি তখনই বারসিক’র কার্য়ক্রম সম্পর্কে জানতে পেরে বারসিক’র কাজের সাথে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। নাসরিন আক্তার উক্ত বিষয়টি বারসিক’র সাথে পরামর্শক্রমে বারসিক কর্মকর্তাসহ একদিন কল্পনা আক্তারের বাড়ি পরিদর্শন ও সমমনা কৃষকদের সাথে অভিজ্ঞতা ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে পারস্পারিক সম্পর্ক তৈরি হয় এবং গ্রামের কৃষকদেরকে রামেশ্বরপুর গ্রামের কৃষক সংগঠনের কার্যক্রম পরিদর্শনের জন্য আমন্ত্রণ জানান। কথা মত একদিন মনসুরপুর গ্রামের তিনজন কৃষক রামেশ^রপুর গ্রামের ‘তুষাইপাড়ের কৃষক সংগঠন’র কার্যক্রম পরিদর্শনে অভিজ্ঞতা বিনিময় সফর করে বীজঘরে বীজ সংরক্ষণ পদ্ধতি ও সমমনা কৃষকদের সংগঠিত হওয়ার কৌশল ও উপকারিতা সর্ম্পকে ধারণা লাভ করেন। পরবর্তীতে কল্পনা আক্তার এহেন কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্থানীয় জাতের সবজি বীজ সংরক্ষণ করে এলাকার কৃষাণীদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ ও বিনিময় করতে থাকেন। আর এভাবেই আস্তে আস্তে তাঁর বাড়িটি গড়ে উঠে একটি গ্রামীণ বীজ বাড়ি হিসাবে। কল্পনা আক্তারের পরিবেশবান্ধব উদ্যোগটিকে আরও গতিশীলতা বৃদ্ধির জন্য বারসিক’র পক্ষ থেকে তাকে বীজ সংরক্ষণের জন্য ২০টি প্লাস্টিকের বয়াম, ৫টি মাটির কলসী ও গ্রামীণ বীজ বাড়ির একটি সাইনবোর্ড দিয়ে সহায়তা করা হয়। উপজেলা কৃষি বিভাগের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন ও সঠিকভাবে বীজ সংরক্ষণের জন্য উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার উপস্থিতিতে বীজ সংরক্ষণ বিষয়ে দিনব্যাপী একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালা আয়োজনে সহযোগিতা করা হয়। এক পর্যায়ে বৈচিত্র্যময় বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ, বর্ধন ও বিনিময়ের লক্ষ্যে কল্পনা আক্তার’র সাথে যুক্ত হন একই পাড়ার সমমনা আরো ১৫ জন কৃষাণী এবং ২০১৯ সালে গড়ে তুলেন “মনসুপুর বিনিময় কৃষাণী সংগঠন” নামের একটি একটি জন সংগঠন।

বিনিময় কৃষাণী সংগঠনের সদস্যদের সকলেই আটপাড়া উপজেলা কৃষি বিভাগ, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও জৈব ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের মধ্য দিয়ে নিজেদেরকে আরো দক্ষ করে তুলেছেন। সদস্যরা বাড়ির আঙ্গিনায় বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ, বীজ উৎপাদন, বীজ সংরক্ষণ করে নিজেরা চাষ করেন এবং গ্রামের অন্যান্য কৃষক-কৃষাণীদের মাধ্যে বিতরণ ও বিনিময় করে থাকেন। গ্রামের একজন প্রবীণ নারী বীজ সংরক্ষণে সুবিধা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কল্পনা আক্তারের গ্রামীণ বীজ বাড়িতে একটি বড় আকারের মাটির একটি মটকা (বীজ জননী) উপহার দেন। মাটির মটকা উপহার পেয়ে কল্পনা আক্তারের উৎসাহ ও আগ্রহ বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি বীজ সংরক্ষণ পদ্ধতি আরো সহজতর হয় এবং খুলে যায় সকলের জন্য বীজ জননীর আর্শীবাদের দোয়ার। বর্তমানে উক্ত বীজ জননীতে ৩০টি বয়মের সঠিক পদ্ধতিতে সবজিসহ বিভিন্ন জাতের শস্য ফসলের বীজ সংরক্ষণ করছেন।

বীজ জননী বলছেন (মটকার গায়ে লেখা)-
‘আমার সন্তানকে বাজারে পাঠিও না,
আমাকে বাজারে পাঠিও না,
আমি বাজারে যেতে চাই না,
বাজার আমাকে বন্ধ্যা বানাবে।’

বীজ সংগ্রহের ক্ষেত্রে সদস্যরা নিজেদের উৎপাদিত ফসলের বাছাইকৃত বীজ সংগ্রহ করে নিজেদের জন্য প্রয়োজনীয় বীজ রাখার পর উদ্বৃত্ত্ব বীজ সংরক্ষণ করে অন্যান্য কৃষকদের মধ্যে বিতরণের জন্য বীজ জননীকে দেন। বিনিমিয় কৃষাণী সংগঠনের মাসিক সভায় বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ বিষয়ক সদস্যরা নিজ নিজ আত্মীয়স্বজনদের সাথে বীজ জননীর কার্যক্রম প্রচারের ফলে আত্মীয়স্বজনরাও তাদের উৎপাদিত ভালো মানের বীজ সংগ্রহ করে বীজ জননীতে পাঠিয়ে দেন।

বীজ জননীর কার্যক্রমের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সাধারণের নিকট তুলে ধরার লক্ষ্যে এবং কার্যক্রম সম্প্রসারণের জন্য বীজ জননীকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর সংগঠনটি বিভিন্ন সরকারী/বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে গ্রামে গ্রামীণ বীজ উৎসব, বীজ বিনিময়, বীজ কেন্দ্রিক কুইজ প্রতিযোগিতা, কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্য উদ্ভিদের মেলা ও নারীবান্ধব গ্রামীণ খেলাধুলার আয়োজন করা হয়। ফলে এলাকার সকল পেশা ও বয়সের শত শত মানুষ স্বতঃস্ফুর্তভাবে অংশগ্রহণ করে তাদের সংগৃহীত কৃষি উপকরণ, নিজেদের জ্ঞান অভিজ্ঞতা ও সুপ্ত প্রতিভা প্রকাশে সক্ষম হয়।

এলাকার কৃষক-কৃষাণীরা বীজ জননী থেকে তাদের প্রয়োজনীয় জাতের শস্য ফসলের বীজ সংগ্রহ করেন এবং বীজ জননীর সাথে বীজ বিনিময় করেন। বীজ জননী থেকে বীজ বিতরণ ও বীজ বিনিময় রেজিষ্টার’র তথ্য অনুযায়ী বিগত এক বছরে বীজ জননী থেকে এলাকার ১২টি গ্রামের ৫৯ জন কৃষক-কৃষাণী ২১ জাতের (লাউ, শিম, মিষ্টি কুমড়া, কুমড়া, ডাটা, লালশাক, মুলা, পেঁপে, পুইশাক, বেগুণ, চিচিঙ্গা, বরবটি, ঝিঙ্গা, ধনিয়া, করলা, পালংশাক, অরহর, কাছাবা, ঢেডস ও কাকরোল) সবজি ও ৮ জাতের ধান (চাপালি, বদ্দীরাজ, চিনিশাইল, বিরই, কালিজিরা, পুট্যাআইজং, কাবুনদোলন ও রতিশাইল) বীজ নিয়েছেন এবং ৬টি গ্রামের ১১ জন কৃষক-কৃষাণী ১০ জাতের (লাউ, শিম, অরহর, ডাটা, ধুন্দল, মরিচ, কুমড়া, মিষ্টি কমড়া, পুইশাক ও বেগুন), বীজ উপহার স্বরূপ বিতরণের জন্য বীজ জননীতে দিয়েছেন।

বিনিময় কৃষাণী সংগঠনের উদ্যোগে বীজ জননী’র বীজ সংরক্ষণ ও বিনিময়ের ভিন্নধর্মী এই উদ্যোগটি উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা (মাসুদুর রহমান) পরিদর্শন করেন এবং উদ্যোগটির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষি অফিস কেন্দ্রিক সকল সুযোগ-সুবিধায় সংগঠনের সদস্যদের যুক্ত করার আশ^াস দেন। পরবর্তীতে উপজেলা প্রশাসনের মাসিক সমন্বয় সভায় সংগঠনের বীজ জননীর এই সৃজনশীল কার্যক্রমের কথা তুলে ধরলে উপস্থিত সকলেই উক্ত কার্যক্রম সম্পর্কে অবগত হন এবং বীজ জননী পরিদর্শনের আগ্রহ প্রকাশ করেন। পর্যায়ক্রমে উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা পরিষদের ৮ জন কর্মকর্তা (উপজেলা নির্বাহী অফিসার, কৃষি, যুব উন্নয়ন, সমাজসেবা ও সমবায় কর্মকতা, উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানগণ) এবং অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ বীজ জননীর কার্যক্রম পরিদর্শন করেন। উপজেলা কৃষি বিভাগ থেকে সংগঠনের সদস্যরা বর্তমানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছে।
বীজ জননী কেন্দ্রিক কার্যক্রম কৃষক-কৃষাণীসহ সকল পেশার মানুষের নিকট গ্রহণযোগ্য হওয়ায় সংগঠনের সদস্যরা এর কার্যক্রম বৃহৎ পরিসরে সম্প্রসারণের স্বপ্ন দেখছেন। এ বিষয়ে তাদের ভবিষ্যৎ স্বপ্নের কথা জানতে চাইলে তারা জানান,
১. প্রতিটি ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে সমমনা পরিবেশবান্ধব চর্চাকারীদের নিয়ে কমিটি তৈরি করে কমিটির মাধ্যমে বীজ জননীর কার্যক্রম পরিচালনা করা।
২. দক্ষ ও তথ্যবিজ্ঞ ব্যক্তির দ্বারা বীজ জননীর প্রতিটি শাখায় ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা।
৩. বীজ জননীর প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে সর্বোচ্চ বীজ সংরক্ষণকারী ও পরিবেশবান্ধব চর্চাকারীদের মাঝে “বীজ জননী” সম্মাননা প্রদান।
৪. সবজি ও মসলাসহ সকল স্থানীয় জাতের বীজ উন্নত পদ্ধতিতে সংরক্ষণ ও বিনিময় করা।
৫. কৃষকরা তাদের কৃষি উপকরণ (বীজ, জৈব সার, হাঁস-মুরগির উর্বর ডিম, কৃষি যন্ত্রপাতি, কুটির শিল্প, মৃৎ শিল্প সামগ্রী ইত্যাদি) বীজ জননীর মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করা।
৬. সরকারি আইন/নীতিমালা, জেন্ডার, স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে প্রকাশনা সংগ্রহ ও পাঠচক্র আকারে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করা।

কৃষাণী কল্পনা আক্তার এর এই ভিন্ন ধর্মী উদ্যোগ, তার চিন্তা ও প্রেরণা প্রতিটি গ্রামের কৃষকের মাঝে ছড়িয়ে পড়–ক, কৃষি হোক কৃষকের, সমৃদ্ধ হোক প্রাণবৈচিত্র্য, প্রকৃতি থাকুক প্রকৃত, ফিরে আসুক কৃষি সার্বভৌমত্ব এই কামনাই রইল।

happy wheels 2

Comments