খাবারের জন্যে আগে চিন্তা করতে হতো না
::রাজশাহী থেকে শহিদুল ইসলাম শহিদ
“খাবারের জন্যে আগে চিন্তা করতে হতো না। বাড়ির বাইরে গেলেই কত শাক পাইছি। তার সাথে জংলী আলু, বনশসা (তেলাকুচা) এগুলোও পাওয়া যেত। আর বর্ষার সময় জমিতে অনেক খাবার পাওয়া যেত। কাজ করে বাড়ি আসার সময় শাড়ির কোছাতে করে শামুক, টাঠা (ছোট শামুক), ঝিনুক, কুঁচা, ব্যাঙয়ের ছাতা (মাশরুম), কাঁকড়া ধরে নিয়ে আনতে পারতাম। এগুলো খেয়েই তো আমরা বেঁচে থাকছি, উপকারও বেশি পাই।” উপরোক্ত কথাগুলো বলেছেন রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার সমাসপুর গ্রামের সুরুজ মনি সরেন। যার বয়স ৯১ বছর। তাঁর আক্ষেপ- আগে তাদেরকে খাদ্যের জন্য, আমিষের জন্য এবং সবজির জন্য কারও ওপর নির্ভর হতে হয়নি। প্রকৃতি থেকেই তারা এসব খাবার পেয়েছেন। তবে আজ প্রকৃতিতে আপন মনে বেড়ে ওঠা এসব খাদ্য বলতে গেলে নেই, কমে গেছে বিভিন্ন বন্য প্রাণীও।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্যানুসারে বাংলাদেশে ৪৫টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী বাস করে। এই ৪৫টি আদিবাসী জনগোষ্ঠির মধ্যে রাজশাহী জেলায় বসবাসরত সাঁওতাল, মুন্ডা, মাহালী, ওরাঁও’রাও রয়েছেন। আদিবাসীরা অনেক বেশি প্রকৃতিনির্ভর। খাবার থেকে শুরু করে তাঁদের জীবন-জীবিকা সম্পর্কিত নানান বিষয়েই প্রকৃতির ওপর তারা নির্ভরশীল। রাজশাহী তথা পুরো বরেন্দ্র অঞ্চলের আদিবাসীরা প্রকৃতি থেকে বিভিন্ন ধরনের খাবার, ফলমূল, জ্বালানি, ওষুধসহ নানান উপকরণ সংগ্রহ করেন। প্রাকৃতিক খাবার সংগ্রহের ক্ষেত্রে অন্যান্যদের তুলনায় আদিবাসীরা সবচে’এগিয়ে রয়েছেন। প্রকৃতি থেকে পাওয়া উদ্ভিজ খাবারে ক্ষেত্রে কমবেশি অন্যান্য মানুষেরা ভাগ বসালেও কিছু কিছু প্রাণীজ খাবার শুধুমাত্র আদিবাসীরাই সংগ্রহ করেন। যেমন- কচ্ছপ, কুঁচে, শামুক, টাঠা (ছোট শামুক), ঝিনুক, কাঁকড়া, খড়গোশ, বনবিড়াল (বন গাবড়া) ও বেজি। এসব প্রাণীজ খাবার প্রকৃতি থেকেই আদিবাসীরা সংগ্রহ করে থাকেন। এই খাদ্যগুলো বরেন্দ্র অঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসীদের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে নানানভাবে প্রকৃতিকে ধ্বংস করা, পরিবেশ বিনাশী কর্মকান্ড এবং মানুষের অসচেতনতার কারণে আজ প্রকৃতিপ্রদত্ত উদ্ভিজ ও প্রাণীজ খাদ্যের যোগান ও উৎস অনেকাংশে কমে গেছে। ফলশ্রুতিতে প্রকৃতি ওপর নির্ভরশীল আদিবাসীদের খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে সাজনী মার্ডী (৪২) বলেন,“আগে আমরা শামুক, টাঠা, ঝিনুক, কুচা, কাঁকড়া অনেক খাইছি, এখন তেমন আর পাওয়া যায় না। জমির আইলের উপর শামুক সাদা সাদা থোকা ধরে ডিম পাড়তো এখন আর দেখা যায় না।”
বরেন্দ্র অঞ্চলের অধিকাংশ আদিবাসীদের নিজস্ব জমি নেই। এমনকি বসবাস করার মত বসত ভিটা পর্যন্ত নেই! অথচ বরেন্দ্র অঞ্চলে কৃষিক্ষেত্রে সবচে’ বড় অবদান রয়েছে এই আদিবাসীদের। অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় হওয়ায় প্রাচীনকাল থেকেই অধিকাংশ আদিবাসী নারী পুরুষ কৃষিকাজে শ্রম বিক্রি করে আসছেন। বরেন্দ্র অঞ্চলে কৃষি ফসলের চারা রোপণ, কর্তন ও নিড়ানির সময় তাঁদের হাতে প্রচুর কাজ থাকলেও অন্যান্য সময়ে কাজহীন অবস্থায় থাকতে হয়। ফলে আয় না থাকায় সংসারে দেখা দেয় অভাব-অনটন। মূলত এই কারণেই তাঁরা খাদ্যের জন্য প্রকৃতির ওপর খুব বেশিই নির্ভরশীল ছিলেন। কাজ না পেলে আদিবাসীরা তাই প্রকৃতি থেকে বিভিন্ন ধরনের অচাষকৃত শাকসবজি সংগ্রহ করতেন, প্রাণীজ খাবার পূরণের জন্য তাঁরা শিকার করতেন বিভিন্ন খড়গোশ, বন গাবড়া ও বেজি। এর মাধ্যমে পূরণ করতেন খাদ্যের চাহিদা। তবে কৃষিতে রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার, অচাষকৃত উদ্ভিদকে আগাছা হিসেবে চিহ্নিত করে নিশ্চিহ্ন করার প্রবণতা এবং বন বা জঙ্গল কমে যাওয়ায় বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর বিলুপ্ত হওয়ায় আদিবাসীরা আগের মতো এসব খাবার প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করতে পারছেন না। এ বিষয়ে নিরেন মুর্মু বলেন,“আগে এগুলো প্রচুর পাওয়া যেত কিন্তু এআর কিছুই পাওয়া যায় না।” প্রকৃতি থেকে পাওয়া খাদ্যের পরিমাণ কমে যাওয়ায় কারণে আদিবাসীদের পরিবারে কি ধরনের প্রভাব ফেলেছে জানতে চাওয়া হলে মিনতি সরেন (২৩), সনতি হেম্ব্রম (৩৬) এবং মালতি হেম্ব্রম (৫৬) জানান, পানি ছাড়া সব কিছু আমরা বাজার থেকেই সংগ্রহ করছি। ফলে আমরা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছি, অতীতে আমাদের একটু কষ্ট করতে হতো কিন্তু ঋণ করতে হতো না।”
সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা আমাদের এই বাংলাদেশ। একসময় প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এই জনপদ। কিন্তু অপরিকল্পিত ও জনবিচ্ছিন্ন উন্নয়ন উদ্যোগ এবং পরিবেশ বিনাসী নানান কর্মকান্ডের কারণে আজ আমাদের প্রকৃতি বিপন্ন, বিপন্ন আমাদের পরিবেশ। উন্নয়নের নামে আমরা জলাশয়গুলোতে মাত্র ৩-৪ প্রকারের মাছ চাষ করার জন্য বিভিন্ন বিষ দিয়ে জলের হাজারও প্রাণীকূলকে নির্দ্বিধায় ধ্বংস করছি। আবার ফসল রক্ষার জন্য নানা রকমের কীটনাশক প্রয়োগের মাধ্যমে মেরে ফেলছি শত শত বিভিন্ন উপকারী প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ। ফলে ভেঙে পড়ছে প্রাণীকূলের খাদ্য শৃঙ্খল, দূষিত হচ্ছে আমাদের চারপাশের পরিবেশ এবং বাধাগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।