শতবাড়ির কৃষক মামুন মিয়ার যত শখ

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়

লক্ষীগঞ্জ ইউনিয়নের চকপাড়া গ্রামে মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারগুলোর মধ্যে মামুনের পরিবার অন্যতম। তারা দুই ভাই সারাবছর কৃষিকাজে ব্যস্ত থাকে। প্রয়োজনে মাঝে মধ্যে শ্রমিক নিয়োগ করে, বিশেষ করে ধানের জমিতে যখন কাজ করতে হয়। তখন তারা একা করে উঠতে পারেনা। দুই মৌসুমে সারাবছর যে ধান চাষ করে তা দিয়ে বছরের খোরাক হয়। আবার বেশ কিছু বাড়তি ধান বিক্রি করতে পারেন। মামুনদের চাষকৃত আবাদী জমির পরিমাণ ৪০ কাঠা, ফিশারী আছে ১২ কাঠা জমিতে, বসতভিটা ৫ কাঠা ও ২.৫ কাঠা জমিতে পুকুর আছে। খুব ছোট বয়সেই মামুনের বাবা মারা যান। এরপর থেকেই তাঁর মা তাদের দুই ভাই ও দুই বোনকে অনেক কষ্ট করে বড় করেছেন। ছেলেরা বড় হয়ে বাবার রেখে যাওয়া জমিতে চাষাবাদ শুরু করে এবং এখন পর্যন্ত করে যাচ্ছে।

মামুন এইচ.এস.সি পাশ করার পর আর পড়ালেখা করেননি। কৃষি কাজে যুক্ত হয়ে বুদ্ধি আর শ্রম দিয়ে নিজের মতো করে চাষাবাদ করে যাচ্ছেন। এর পাশাপাশি তিনি স্থানীয় যুবদের সমন্বয়ে গড়ে উঠা যুব সংগঠন ‘বন্ধু মহল’ এর একজন সক্রিয় সদস্য। এলাকায় বিভিন্ন সামাজিক কাজে তিনি সবসময় অংশগ্রহণ করে থাকেন। তিনি তার সমবয়সীদের সাথে নিয়ে নিজের এলাকায় পাখি শিকার করা বন্ধ করেছেন। তার আরেকটি অভ্যাসের মধ্যে খেলাধূলা অন্যতম। সারাদিন কৃষি জমিতে কাজ করার পর এলাকার সমবয়সীদের সাথে প্রতিদিন বিকেল বেলা ফুটবল বা ক্রিকেট খেলায় মেতে উঠেন।

ছোট বেলা থেকেই মামুনের কৃষিকাজে ঝোঁক ছিল। কোন জমিতে কি ধরণের ফসল চাষ করলে ভালো উৎপাদন সেভাবেই তিনি জমি নির্বাচন করেছেন। তার সব্জী চাষের জন্য দুই ধরণের জমি আছে, উঁচু ও নিচু। নিচু জমিতে শীতকালে ডাটা, আলু, মরিচ, টমেটো ও দেশিলাউ এবং বর্ষাকালে উঁচু জমিতে চিচিঙ্গা, শশা, ঢেঁড়স, বরবটি, মিষ্টিকুমড়া চাষ করেন। এছাড়াও বসতভিটায় ঝিঙ্গা, ধুন্দল, পুঁইশাক, শিম, দেশিলাউ, মিষ্টিকুমড়া ইত্যাদি চাষ করে, যা দিয়ে সারা বছরের খাবার চলে। এ বছর প্রায় ১১ হাজার টাকার ক্ষিরা, বরবটি, ঢেঁড়স, পুঁইশাক ইত্যাদি বিক্রি করেছেন। এভাবে বিভিন্ন সব্জী বিক্রি করে তিনি বছরে প্রায় ৪০ হাজার টাকা উপার্জন করে থাকেন। সব্জী বিক্রি করার চাইতে তিনি বিতরণ করেন বেশি। তাছাড়া সারাবছর পরিবারের খাওয়া তো আছেই।

বসতভিটার আশে পাশের পতিত জায়গা, পুকুরপাড়, সব্জীর ক্ষেত, বিল ইত্যাদি জায়গা থেকে বিভিন্ন অচাষকৃত উদ্ভিদ যেমন কলমীশাক, থানকুনি, বউত্তা, খুইরা, হেলেঞ্চা, সোনাবন ইত্যাদি সংগ্রহ করে খায়। বাড়ির পিছনের জায়গায় আছে বাঁশঝাড়। প্রয়োজন মতো নিজেরা ব্যবহার করে এবং গ্রামে যাদের প্রয়োজন হয় তাদেরকেও দিয়ে সহযোগিতা করে। কিন্তু এর বিনিময়ে কখনো টাকা নেয়না।

মামুন মিয়ার পুকুরে সব ধরণের স্থানীয় জাতের মাছ আছে, যা দিয়ে পরিবারের সবার সারা বছরের খাওয়া চলে। আত্মীয় ও প্রতিবেশিদের মাঝেও বিতরণ করে। এছাড়া স্থানীয় বিল (বেহি বিল) থেকে বর্ষা ও শীতকালে মাছ সংগ্রহ করে। সেই মাছ খায় এবং শুকিয়ে সংরক্ষণ করে। মামুন বছরের সব সময় বিভিন্ন ধরণের প্রাণিসম্পদ পালন করে থাকে। দূরদূরান্ত থেকে শখের প্রাণি সংগ্রহ করে। বর্তমানে তাঁর বাড়িতে ৭টি আঁচিল মুরগি আছে। আরো আছে দেশি মুরগি ১০টি, চিনাহাঁস ১১টি, দেশিহাঁস ১৩টি ও গরু ৮টি। প্রতিবছর কোরবানি ঈদের সময় প্রায় এক লাখ টাকার মতো ষাড় গরু বিক্রি করতে পারে। সব্জী ও ধান চাষে সংরক্ষিত গোবর ব্যবহার করে। গাভীর দুধ খায় সারাবছর। এছাড়া হাঁস মুরগির ডিমও বাড়ি থেকেই খেতে পারে, কিনতে হয় না।
বিভিন্ন ফলের গাছ লাগানো মামুনের আরেকটি শখ। সব ধরণের স্থানীয় জাতের ফলজ গাছ যেমন আম, জাম, কাঁঠাল, নারিকেল, লিচু, বেল, জাম্বুরা, আমড়া, বিলম্ব, আতাফল, ডালিম, বড়ই, পেয়ারা, লেবু, কলা, অড়বড়ই, চালতা, বুবি (লটকন), কামরাঙ্গা, আমলকি, সফেদা ইত্যাদি তার বাড়িতে আছে। এছাড়া বিভিন্ন ধরণের আম গাছ যেমন হিমসাগর, গোপালভোগ, মোহনভোগ, আ¤্রপালি, আষাঢ়ি, বারোমাসী জাতের আম গাছও রয়েছে। ফল কখনো বিক্রি করেনা। নিজেরা খায় আবার প্রতিবেশিদের মাঝেও বিতরণ করেন। তার পরিচালনায় নিজস্ব কৃষিকাজে একদিকে যেমন নিজের পরিবারের পুষ্টির চাহিদা পূরণ হচ্ছে অন্যদিকে গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলোও উপকৃত হচ্ছে। এলাকায় যুব কৃষকদের অনুপ্রেরণা হলো মামুন মিয়া। তার কার্যক্রম দেখে অনেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে পড়ালেখার পাশাপাশি কৃষিকাজে যুক্ত হচ্ছে।


বর্তমান সময়ে আমাদের চারপাশে তাকালে দেখা যায় মেধাবী, দক্ষ, সৃজনশীল যুবরা কর্মহীনতায় বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। অথচ এই যুবশক্তির উদ্যমে আমাদের দেশের সার্বিক উত্তোরণ। তাদের মেধাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমরা আমাদের কৃষিখাতকে আরো উন্নত করতে পারি। শিক্ষিত যুবরা যদি চাকরির পেছনে না ছুটে মামুনের মতো কৃষি কাজে এগিয়ে আসে তবে বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম শস্যফসলে আবারো ভরে উঠবে।

happy wheels 2

Comments