এখন অনেকেই আসে আমার বাড়িতে
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
শাহানারা বেগম। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার কাশিমাড়ি ইউনিযনের জয়নগর গ্রামের একজন নারী। স্বামী ও দু’কন্যা সন্তান সহ মোট ৪ সদস্যের সংসার তাঁর। নিজেদের জমিজমা বলতে কৃষি জমি ও বসতভিটাসহ ২বিঘা। তার মধ্যে প্রায় ১৫ কাঠার মতো বসতভিটা এবং বাকিটা ধান চাষ করেন। তিনি তার এই স্বল্প বসতভিটায় বছরব্যাপী নানান ধরনের ফসল চাষাবাদ করেন। বসতভিটায় সবজি চাষের পাশাপাশি তিনি গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন করেন। পুকুরে নানান ধরনের মাছ চাষও করেন। সব কিছু মিলিয়ে তিনি একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ কৃষি বাড়ি তৈরি করার চেষ্টা করছেন।
বিগত সমযে বারসিক’র ধারাবাহিক কাজের অংশ হিসাবে কোভিড-১৯ মহামারীকালে পুষ্টিভিত্তিক কৃষির মাধ্যমে তৈরি কৃত ‘পুষ্টি ব্যাংক’ বা শত বাড়ি তৈরির লক্ষ্যে শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে বিভিন্ন গ্রামে বাড়ি নির্বাচন করা হয়। তার মধ্যে শাহানারা বেগমের বাড়িটি ছিলো একটি। এছাড়াও শাহানার বেগম একজন কর্মঠ নারী। সংসারের উন্নতির জন্য দিনভর পরিশ্রম করে থাকেন। শাহানারা বেগমের বাড়িতে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ চলমান রয়েছে। তার চাহিদা অনুযায়ী নেট, মটর ও ফাঁস জাল সহায়তা করা হয়েছে।
শাহানারা বেগমের বাড়িটি শতবাড়ি হওয়াতে এবং বারসিক থেকে সহায়তা দেওয়ার পর তার জীবনযাত্রায় কি ধরনের পরিবর্তন হয়েছে এ বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে বলেন, ‘আমার বাড়িটি শত বাড়ি তৈরির আগে থেকেই আমরা সবজি চাষ করতাম। বাইরের যে ক্ষেত ছিলো সেটা পড়ে থাকতো। এছাড়াও কলসে করে দূর থেকে পানি এনে দিতে হতো। আগে সবজি করতাম কিন্তু তা পরিমাণে কম। শতবাড়ি তৈরি ও সহায়তা পাওয়ার পরে কিছুটা হলেও পরিবর্তন বুঝতে পারছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ সহায়তা আমার কাজের গতিকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন প্রায় সময় ক্ষেতে সবজি থাকে। সবজি বিক্রি করে যেমন আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছি তেমনি পরিবারের প্রয়োজন মিটাতে পারছি। বাইরের যে ক্ষেত ছিলো সেখানে বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করেছি। এবছর শীত মৌসুমে লালশাক, পালনশাক, মূলা, ওলকপি, বীটকপি, বেগুন, পাতাকপি, ফুলকপি, মিষ্টিকুমড়া, শিম, ঝাল, পেয়াজ ও রসুন লাগিয়েছিলাম। পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে প্রায় ৩৫০০ টাকার সবজি বিক্রি করেছিলাম। এছাড়াও বাড়িতে উৎপাদিত এবং গ্রাম থেকে ডিম কিনে এনে হাঁস-মুরগির বাচ্চা ফুটিয়ে বিক্রি কাজ করে থাকি। বাড়িতে ২টি গরু, ২টি ছাগল, ৫টি পাতি হাঁস, ৩টি মেরি হাঁস এবং ২৭টি মুরগি রয়েছে। এছাড়াও পুকুরে আছে হরেক রকমের স্থানীয় মাছ হয়। ’
তিনি আরও বলেন, এখন থেকে আমি বীজ সংরক্ষণ করেছি। করোনাকালীন সময়ে গ্রামের প্রায় ২২ জনকে বিভিন্ন ধরনের সবজি খেতে দিয়েছিলাম। বর্ষাকালীন প্রায় ১৩ জনের মাঝে লাউ, বরবটি ও মিষ্টিকুমড়া বীজ সহায়তা করেছি। এছাড়াও আমার এটি শতবাড়ি হওয়াতে এখানে সবজি চাষ, বীজ সংরক্ষণ, করোনার সচেতনতা, জৈব বালাইনাশক তৈরি, স্থানীয় গলাছেলা মুরগি চাষ ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হয়। এখন সবজি চাষ করে অন্যদেরকে সহায়তা করতে পারি এতে খুব ভালো লাগে। আগে তো আমার বাড়ি কেউ আসতো না এখন অনেকেই আসে আমার বাড়িতে বীজ ও সবজি নিতে। এতে করে প্রতিবেশিদের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। তাছাড়া পরিবারের আয়ের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখায় সমাজ ও সংসারে সম্মান কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে করি। সবচেয় বড় কথা হলো এখন আর কারোর উপর নির্ভর করতে হয় না।’
উপকূলীয় এলাকায় শাহানারা বেগমের মতো যেসব নারীরা প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে আমাদের কৃষি সংস্কৃতিকে আগলে রেখে জীবিকা নির্বাহে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে তাদেরকে মূল্যায়নের মাধ্যমে তাদের কাজকে আরো গতিশীল করতে হবে এবং তাঁদের কাজকে স্বীকৃতি দিয়ে তাঁদের উৎসাহিত করতে হবে।