‘নবজাগরণ’- এর শিক্ষার মশাল
:: রাজশাহী থেকে ইসমত জেরিন ও রাজু আহমেদ বাপ্পী::
নবজাগরণের শিক্ষা নিকেতন
নবজাগরণ ফাউন্ডেশন একটি যুববকদের সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এ সংগঠনের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছিল পথশিশুদের ঈদের কাপড়, শীতের কাপড়, শিক্ষার সামগ্রী ইত্যাদি বিতরণ করার মধ্য দিয়ে। এছাড়া পথশিশুরা যাতে বিদ্যালয়মূখী হয় সেজন্য সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে কাজ করে। পরবর্তীতে শিক্ষার এই কাজকে সম্প্রসারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতেই নবজাগরণ শিক্ষা নিকেতনের পথচলা শুরু হয়। বর্তমানে শিক্ষা নিকেতনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৫০জন শিক্ষার্থী শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। শিক্ষা নিকেতনে ২৫ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। শিক্ষা নিকেতনের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার প্রয়োজনীয় সামগ্রী নবজাগরণ থেকেই দেওয়া হয়।
শিক্ষা নিকেতন শুরু নেপথ্য
দিনটি ছিল ১২ই ডিসেম্বর, ২০১২। “নবজাগরণ” ফাউন্ডেশনের গল্পের পসরার দিন। পড়াশোনার পাশাপাশি সময়কে কাজে লাগিয়ে ভালো কোন কিছু করার উদ্যোগে মূলত এই সংগঠনের সৃষ্টি। সেদিন নবজাগরণ ফাউন্ডেশনের সদস্যরা সবাই মিলে বসেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ মখদুম হলের ক্যান্টিনে চায়ের ফাঁকে আড্ডা দিতে। এ সময় সবাইকে চা দিতে দিতে ক্যান্টিনের এক কর্মচারী বললেন, “মামারা আপনারা এত কিছু করেন আমাদের ছেলে মেয়েদের পড়ালেখার জন্য কিছু করতে পারেন না ?” তার কথায় আকৃষ্ট হয় শিক্ষার্থীরা। পরবর্তীতে তার সাথে আলোচনায় নবজাগরণের সদস্যরা জানতে পারেন তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে হরিজন পল্লীতে থাকেন। হরিজন পল্লীতে দারিদ্র্য ও সামাজিক অবস্থানের কারণে বেশির ভাগ শিশুই শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ে। মূলত এই সম্প্রদায়ের মানুষেরা শহরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব পালন করেন। নিরক্ষরতার কারণে এসব মানুষেরা তাদের শিশুদের শিক্ষার ব্যাপারে খুব একটা সচেতন নয়। এছাড়া তাদের সামাজিক অবস্থান ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এসব মানুষেরা খুব একটা গুরুত্ব পান না অন্যের কাছে। ফলশ্রুতিতে তারা বংশপরম্পরায় শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হন। নবজাগরণের সদস্যরা ভাবেন, এ জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করে তুলেতে হবে, তাদের হাতে শিক্ষার আলোর মশাল দিতে হবে। তারা ভাবেন, যে বিদ্যাপীঠ থেকে জ্ঞানের আলোর মশাল জ্বালিয়ে দেশ বিদেশে জ্ঞানচর্চায় ব্রত হাজার মানুষ, সেই বিদ্যাপীঠের পাশে অশিক্ষায় কোনভাবেই থাকতে পারেন না এই হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষেরা! নবজাগরণের সদস্যরা তাই উদ্যোগ নেন এ জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করে তুলতে। এভাবে হরিজন সম্প্রদায়ের একাত্মতা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই গড়ে ওঠে “নবজারণ শিক্ষা নিকেতন”।
শিক্ষা নিকেতন ব্যবস্থাপনা ও পাঠদান
এই শিক্ষা নিকেতনকে সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য নবজাগরণের সদস্যদের নিজস্ব একটা ব্যবস্থাপনা রয়েছে। এছাড়া শিক্ষা নিকেতনের একটি উপদেষ্টা কমিটি রয়েছে যারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন্ বিভাগের শিক্ষক। শিক্ষা নিকেতনের কার্যক্রমের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণের জন্য প্রতিমাসে একবার সভা হয়। সদস্যদের মধ্যে এবং প্রতি দুইমাস পর পর অভিভাবকদের সাথে সভা হয়। সভায় মূলত শিক্ষাকার্যক্রমের অগ্রগতি ও পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়। অন্যদিকে পাঠদানের ক্ষেত্রে বাংলা, ইংরেজি, অংক পাঠ্যক্রমের পাশাপাশি স্বাস্থ্যগত ও সামাজিক শিক্ষাও দেয়া হয়। নবজাগরণের সদস্যরা যে বিষয়ে পারদর্শী সেই বিষয়টিই বেছে নেন শিক্ষার্থীদের পাঠদানের করার জন্য। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় আগ্রহ বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন সময় কার্টুন, শিক্ষামূলক প্রামাণ্যচিত্র, ছবিও দেখানো হয়। সপ্তাহে একদিন চিত্রাংকন শেখানো হয়। এছাড়া পূজা ও অন্যান্য উৎসবের সময় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে নবজাগরণ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় যেখানে হরিজন সম্প্রদায়সহ অন্যান্য শিশু অংশগ্রহণ করেন। এসব অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও উপস্থিত থাকেন।
শিক্ষা তহবিল সংগ্রহ
ছোট বা বড় যেকোন উদ্যোগের সফল বাস্তবায়নের জন্য কম বেশি হলেও অর্থের প্রয়োজন হয়। নবজাগরণের সদস্যরা যাদেরকে পাঠদান করেন তারা দরিদ্র সম্প্রদায় থেকে এসেছে। তাই শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ শিক্ষা নিকেতন থেকেই দিতে হয়। এসব উপকরণ ক্রয় ও সংগ্রহ করার জন্য শিক্ষার্থীরা বা নবজাগরণের সদস্যরা প্রত্যেকে মাসে ৩০ টাকা করে চাঁদা দেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এবং চাকুরিজীবীদের কাছ থেকেও অনুদান সংগ্রহ করেন তারা। এছাড়াও তারা বিভিন্নভাবে অর্থ সংগ্রহ করার চেষ্টা করেন। এভাবেই তারা তাদের সাধ্যমত অর্থ সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় উপকরণ ক্রয় করে শিক্ষাকার্যক্রমকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করছেন।
নবজাগরণের সদস্যদের স্বপ্ন
নবজাগরণের সদস্যরার চান এই নিকেতনের যেকোন শিক্ষার্থী যতদূর পর্যন্ত পড়তে চায় ততদুর পর্যন্ত তারা সহযোগিতা করবেন। তারা স্বপ্ন দেখেন তাদের এই উদ্যোগ অন্যের কাছে মডেল হিসেবে আর্বিভূত হবে। যাতে অন্যরাও এটা দেখে ভালো উদ্যোগ নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। নবজাগরণের এই উদ্যোগের কারণে অনাদর আর অবহেলায় পড়ে থাকা শিশুরা শিক্ষা লাভ করতে পারছে। এই শিশুরা আজ পড়াশোনার স্বপ্ন দেখছে, স্বপ্ন দেখছে একদিন তারাও ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, বৈমানিক হবে। আবার কেউ কেউ স্বপ্ন দেখছে বড় হয়ে এমনিভাবেই তারাও শিক্ষা বিস্তারে অবহেলিতদের পাশে দাঁড়াবে। একটি ক্ষুদ্র উদ্যোগ এভাবেই মানুষের মুখ হাসি যেমন ফোঁটায়, স্বপ্ন দেখতে সাহসী করে ঠিক তেমনি এ ক্ষুদ্র উদ্যোগের মাধ্যমে অবহেলিত মানুষেরা তাদের মেধা ও মনন বিকাশে সুযোগ লাভ করে। কে জানে এদের মধ্য থেকেই হয়তো একদিন আমরা আইনস্টাইন, নিউটন পাবো, পাবো মহাত্মা গান্ধী বা নেলসন ম্যান্ডেলার মতো সম্মোহনী নেতৃত্বগুণের মানুষ!