ঘূর্ণিঝড় বুলবুল: একজন প্রবীণের আতংক

শ্যামনগর থেকে চম্পা রানী মল্লিক

শান্তি রানী মন্ডল (৮৫)। স্বামী মৃত হাজারী লাল মন্ডল। বাস করেন বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের বিলাইট গ্রামে। তাঁর চার ছেলে আছে। অভাবের তাড়নায় অনেক কষ্টে মানুষের বাড়িতে কাজ করে সন্তানদেরকে বড় করেছেন। এই বয়স পর্যন্ত তিনি অনেক জীবন যন্ত্রণার পাশাপাশি দুর্যোগের ও অনেক যন্ত্রণা সয়ে নিয়েছেন। এক একটা দুর্যোগের পর ছেলেরা অনেক কষ্টে একটু একটু করে ঘরগুলো উঁচু না করতেই আর একটা দুর্যোগ এসে হাজির হয়।

20191118_110950
ঘূর্ণিঝড় বুলবুল সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি তো কানে খুব কম শুনি, কাছে এসে অনেক জোরে না বললে শুনিনা। তাই ছেলেরা যখন মাইকিং এর মাধ্যমে সংবাদ শোনে তখন আমাকে অনেকবার বলছিল ইউনিয়ন পরিষদে রেখে আসার জন্য, তখন অনেক ভয় পাওয়া স্বত্বেও সন্তানদের রেখে যেতে মন চায়নি। কারণ ওদের রেখে আমি থাকতে পারি না। এদেরকে আমি মোটেই চোখের আড়াল করতে চাই না, তাই ইউনিয়ন পরিষদে না গিয়ে ওদেরকে বললাম বাঁচি যদি একসাথে বাঁচবো আর মরি যদি একসাথে মরবো।’ তিনি আরও বলেন, ‘সন্ধ্যায় যখন টিপ টিপ বৃষ্টি ও হালকা বাতাস হচ্ছিল তখন আমরা সবাই রাতের খাওয়া তাড়াতাড়ি শেষ করি। তারপর আমার ছোট ছেলের দুই ছেলেকে ও আমার জার (দেবরের স্ত্রী) বোনকে নিয়ে শুয়ে পড়ি, কিন্তু আতংকে ঘুম আসেনি। সবাই কথা বলতে থাকি। রাত যত গভীর হয় আস্তে আস্তে বৃষ্টি ও ঝড় বাড়তে থাকে। আতংকে তখন বুক যেমন কাঁপে, গলা ও শুকিয়ে যেতে থাকে, তখন উঠে কিছু কাঁথা কাপড় গুছিয়ে রাখি তারপর আবার শুই। এ সময় আমি ছোট ছেলের ঘরে ছিলাম। বার বার যখন ঝড় ঝাপটা দিতে লাগলো তখন সবাই উঠে পড়ি এবং হাঁকাহাঁকি করতে থাকি, শব্দ শুনে অন্য ঘর থেকে ছেলে বৌমারা সবাই আমার কাছে আসে।’

তিনি জানান, তাঁরা এক জায়গায় সবাই মিলে জড়ো সড়ো হয়ে ঘরের বারান্দায় বসেন। কারণ ঝড়ের যে গতিবেগ তাতে করে দেয়াল পড়ে যেতে পারে। এরই মধ্যে ঘরের মাটির দেয়াল পড়ে যায় এবং ঘরের টিনের ছাউনি উত্তর দিকেরটা উড়ে যায়। তখন সবাই কাঁদেন আর ভয়ে হাঁকাহাঁকি করেন। দেয়াল যখন পড়ে যায় তখন প্রচুর ঝাপটা ও বৃষ্টির জল দরজা দিয়ে বারান্দায় আসতে থাকে! তখন বাতাসের এমন গতি ছিল যে খোলা দরজাটা যে তারা বন্ধ করবেন তাও পারছিলেন না। কোন রকমে অনেক কষ্টে বন্ধ করে এবং কিছু জিনিস কাছে নিতে পারেন বাকি সব ভিজে যায়। এরপর চোখের সামনে মানুষের কাছ থেকে ধার করে অনেক কষ্টে তিল তিল করে বাঁধা তাঁর সেজো ও মেজো ছেলের ঘর দুটোও পড়ে যায়, যার ঋণের বোঝা এখনো শোধ হয়নি। গলা ছেড়ে কাঁদতে থাকেন, কিন্তু কে শোনে কার কান্না, এভাবে ভয়ানক তান্ডবের ভেতর দিয়ে সকাল হলো কিন্তু ঝড়ের গতি থামেনি।

20191118_111129
পরিস্থিতি বেগতিক দেখে তাঁর ছেলেরা আর দেরি না করে নাতিদের সাথে তাঁকে নিয়ে প্রায় ২ কিলোমিটার পথ হেঁটে ইউনিয়ন পরিষদে রেখে আসেন। ৪ দিন পর তাঁরা বাড়ি ফিরেন। শান্তি রানী মন্ডল বলেন, ‘আসার পরে চারিদিকে শুধু দেখছি আর ভাবছি আহারে কি হবে! কি করে ওরা ঘর বাড়ি ঠিক করবে! কোথায় আবার টাকা পাবে! কে দেবে ওদের টাকা! ওদের যে এই ভিটাটুকু ছাড়া কোন জমি নেই। আগের ঋণ এখনো শোধ হয়নি। ছেলেদের ও মাথায় হাত।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি বারবার বলতে থাকি কিভাবে সংসার চালাবো, আর কিভাবে এই ঘর ঠিক করবো। আগের ঋণের টাকা এখনো মানুষ চায়, সেই টাকা কিভাবে শোধ করবো? আর কতদিন ধরে আবার টাকা জমাবো ঘর ঠিক করার জন্য। এরকম বহু কথা, তবে আমি ওদেরকে বুঝাচ্ছি যে, সবাই যদি ভালো থাকে তাহলে তোরা ও ভাল থাকবি।’

তিনি মনে করেন, এত ঝড়ঝাপ্টার মধ্যেও তাঁর ছেলেরা আবার ঘর ঠিক করবে, আর সেই ঘরে আমি থাকতে পারবেন! তবে তিনি কোনভাবেই সেদিনের ঝড়ের ঘটনা ভুলতে পারছেন না। ঘূর্ণিঝড় বুলবুল এভাবেই তার মনে আতংক সৃষ্টি করেছে।

happy wheels 2

Comments