মিষ্টি পানি থাকলে বারোমাস সবজি চাষাবাদ করতে পারতাম
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
’বাড়ির চারপাশে পানি আর পানি। এসব পানি হলো লবণ পানি। সংসারের সব রকম কাজে পানির কোন বিকল্প নেই। আমাদের প্রতিদিনকার কাজে পানি ব্যবহার করতে হয়। শুধুমাত্র খাবার পানিটা বাদ দিয়ে এই লবণ পানিতে আমাদের গোসল, থালা বাসন ধোওয়া, কাপড় কাচাসহ নানান ধরনের কাজে ব্যবহার করতে হচ্ছে। খাবার পানি বাইরের গ্রাম ও বাজার থেকে কিনে এবং বর্ষার সময় কিছুদিন সংরক্ষণ করে খেতে পারি। আমাদের প্রতিদিনকার খেলার সাথী যেন এই লবণ পানি! আমরা এই লবণ পানির সাথে প্রতিনিয়ত পাল্লা দিয়ে চলতে হচ্ছে।’ উপরোক্ত কথাগুলো বলেছেন শ্যামনগর উপজেলার ইশ্বরীপুর ইউনিয়নের গুমানতলী গ্রামের কৃষাণী মর্জিনা বেগম।
বিগত সময়ে মাঠ পর্যবেক্ষণে কোভিড-১৯ মহামারীকালে পুষ্টিভিত্তিক কৃষির মাধ্যমে তৈরিকৃত পুষ্টি ব্যাংক বা শতবাড়ির তৈরির লক্ষ্যে আগ্রহী উদ্যোগী পরিবার চিহ্নিত করার জন্য গুমানতলী গ্রামের মর্জিনা বেগমের সাথে কথা হয়। তাঁর কাছ থেকে বাড়ির চারপাশে লবণ পানি এবং এই লবণ পানির মধ্যে কিভাবে বিভিন্ন ধরনরে সবজি চাষাবাদ করেছেন তা জানতে চাইলে তিনি উপরোক্ত কথাগুলো বলেন।
মর্জিনা বেগম বলেন, আমার বিয়ে হয়েছে এই গ্রামে প্রায় ১৮ বছর হচ্ছে। সেখান থেকে এসে দেখছি আমার ঘরের চারপাশে লবণ পানির চিংড়ি ঘের। লবণের মাত্রা এতই বেশি যে, কোন ফলজ গাছ বা সবজি চাষ করা সম্ভব হয় না। বিয়ের কয়েক বছর চেষ্টা করেছি কিন্তু কোন সবজি উৎপাদন করতে পারিনি। তবে বিগত কয়েকবছর আগে আমাদের পাশের জাওয়াখালী গ্রামে বারসিক এর উদ্যোগে সবজি চাষ, বীজ সংরক্ষণ এরকম বিষয়ে আলোচনা হয়। গাবুরা ও বুড়িগোয়ালিনী, পানখালী গ্রামে সরাসরি নদীর লবণ পানির পাশে অনেকে সবজি চাষ করে সফল হয়েছেন সে বিষয়ে জানতে পারি।
মর্জিনা বেগম জানান, তরকারি ও চাল ধোয়া পানি ব্যবহার করেও বিভিন্ন সবজি চাষ এবং বর্ষা মৌসুমে লবণের মাত্রা কম থাকে এবং সেসময় বিভিন্ন সবজি চাষাবাদ করলে তা ভালো হবে বলে তিনি জানতে পারেন। সে অনুযায়ী পরের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে বর্ষা মৌসুমে সবজি আবাদ করতে শুরু করেন তিনি। সবজির মধ্যে তিনি লাউ, চালকুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, শসা, পুইশাক চাষ করে ভালো ফলন পেয়েছেন। এছাড়াও্ শীতের সময় লালশাকও লাগিয়েছিলেন। এরপর থেকে তিনি তার বসতভিটায় বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষাবাদ করেন। তিনি জানান, গত বছর বারসিক থেকে গলাছেলা মুরগি পালনের সহায়তা পেয়েছেন। চলতি বছরেও তাঁর বাড়িটি শতবাড়ি বা পুষ্টি বাড়ির জন্য বারসকি থেকে সবজি চাষের উপকরণ সহায়তা করা হয়েছে। এখন সবজি চাষের পাশাপাশি তিনি আমি হাঁস-মুরগি ও ছাগল পালন করছেন। শীতের সময় কিছু জৈব সার ক্ষেতে দিয়ে লালশাক, পালনশাক, ওলকপি, বীটকপি, শিম ও লাউ লাগাবেন বলে জানান।
তিনি বলেন, আমার মোট ১৫ কাঠা জায়গা রয়েছে। এই জায়গায় একটি পুকুর আছে যেখানে আমি লবণ পানির মাছ চাষ করি। তাছাড়া আমার বাড়ির চারপাশে লবণ পানি থাকায় মিষ্টি এলাকার মতো সবজি হয় না। কিন্তু যেটা হয় সেটা আমাদের কাছে অনেক। সংসারের প্রয়োজন মিটিয়ে মাঝে মধ্যে বিক্রি করতে পারছি। সাথে গবাদি পশুও পালন করতে পারছি। আমাদের এখানে যদি মিষ্টি পানি থাকতো তাহলে আমরা বারো মাস সবজি চাষাবাদ করতে পারতাম। তারপরও লবণেরর মধ্যে আমিসহ আমাদের গ্রামের প্রায় বাড়িতে কম বেশি করে সবজি লাগানোর চেষ্টা করছে সবাই।
ভৌগলিক ও কৃষিপ্রতিবেশ ভিন্নতার কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ভু-গর্ভস্থ পানি লোনা। যে কারণে এই এলাকার মানুষেরা বৃষ্টির পানি বিভিন্ন ডোবা, নালা, খাল ও পুকুর খনন করে তা সংরক্ষণের চেষ্টা করেন। কিন্তু সব স্থানে তা সম্ভব হয়ে উঠেনা। লবণ পানির চিংড়ি ঘের সম্প্রসারণ হয়ে সেসব উৎসগুলো নষ্ট হওয়ার উপক্রম হচ্ছে। তারপরও নিজস্ব জ্ঞান –দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে উপকূলীয় মানুষেরা নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার এক দৃষ্টান্ত হতে পারে মর্জিনা বেগম।