প্রকৃতির সাথে বাঙালির পহেলা বৈশাখের রয়েছে গভীর সম্পর্ক
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
আমাদের নিজস্ব কিছু ঐতিহ্য সংস্কৃতি রয়েছে প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে। আমার জীবনধারার সকল ক্ষেত্রে জড়িয়ে আছে ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আঙ্গিক। আমাদের সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন ধরণের গ্রামীণ উৎসব। পরস্পরের সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো শক্তিশালীকরণ, সামাজিক সমস্যা সমাধানে জনসমর্থন তৈরি, বয়স, ধর্ম, পেশা ও বর্ণ নির্বিশেষে সকলের অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি এবং প্রকৃতিনির্ভর নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রদর্শনের লক্ষ্যে বালি গ্রামে যুবক, কিশোর-কিশোরীরা বৈশাখী উৎসব উদ্যাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
প্রাথমিক স্তরের জনগণ ও প্রতিষ্ঠান যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবি মানুষ, প্রবীণ, যুবক, নারী, সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিত্ব, স্থানীয় প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ ও আলোচনা এবং গ্রামের সকলের মতামতের গুরুত্ব প্রদান ও অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণে বালি যুব সংগঠন বিভিন্ন ধরণের কার্যক্রমের উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। যেমন-নিজস্ব সংস্কৃতি রক্ষায় বৈশাখী র্যালি, প্রকৃতির সাথে বাঙালির সংস্কৃতির সম্পর্ক বিষয়ে আলোচনা, সামাজিক ও ঐতিহাসিক ইস্যুতে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, যেমন-আমার ৭১, মাদক, আমার পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়ে নাটক। স্থানীয় খেলাধুলা আয়োজন (বউচি, হাডুডু, কানামাছি), মেহেদী উৎসব, আলপনা অংকন, চেয়ার দখল, সাংস্কৃতি অনুষ্ঠান (নাচ, গান) বাঁশির মধুরতা, স্থানীয় নিরাপদ খাবার পরিদর্শন ইত্যাদি। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বয়সের, ধর্মের, পেশাজীবী মানুষের প্রায় ১৫০০ মানুষ অংশগ্রহণ করে।
বালি যুব সংগঠনের উদ্যোগে বাহারী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উদ্যাপিত হয় পহেলা বৈশাখ। স্থানীয় প্রশাসন, শিক্ষক, শিক্ষাথী, যুবক, নবীন, প্রবীণ সকলের অংশগ্রহণে বৈশাখী র্যালির মধ্য দিয়ে দিবসের কার্যক্রম শুরু হয়। র্যালি শেষে ‘প্রকৃতির সাথে বাঙালির সম্পর্ক’ বিষয়ে এক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন গ্রামের সংস্কৃতিমনা মানুষ ও শিক্ষক মহোদয়গণ। যুব সংগঠনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত নাটকে বিভিন্ন গ্রামের যুবক ও কিশোর-কিশোরীরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যুবকদের অংশগ্রহণকে তুলে ধরে এবং ঐতিহাসিক সমস্যা সমাধানে জনসমর্থনকে তুলে ধরে। বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রকাশ বিজয় এর মাধ্যমে তা প্রদর্শন করে।
সমাজের ভবিষ্যত যুব শক্তি হারিয়ে যাচ্ছে মাদকের গভীরতায়। সৃষ্টি হচ্ছে নানান অসঙ্গতি, অশালীনতার কবলে নবীন-প্রবীণের সম্পর্ক আজ বিলীন হচ্ছে। সমাজের মানুষের নৈতিক অবস্থার অস্তিত্ব হারাচ্ছে বাঙালি। এলাকার যুবকদল তাদের নাটকে এসব বিষয় তুলে ধরে। সকলের যুক্ততায়, পরস্পরের সহযোগিতায়, সাংস্কৃতিক চর্চা, স্থানীয় খেলাধূলা চর্চাই পারে সুস্থ সুন্দর সমাজ গঠনে, দেশ গঠনে এবং যুব সমাজকে ক্ষয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে।
বিভিন্ন ধরণের আধুনিক খেলাধুলার জন্য (ফুটবল, ক্রিকেট) প্রয়োজন হয় উপকরণ ও অর্থের। কিন্তু স্থানীয় গ্রামীণ খেলায় উপকরণ বা অর্থ কোনটারই প্রয়োজন হয়না। উপকরণ যা লাগে তা প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করা যায়। যেমন- বউচি, কানামাছি, গোল্ল¬াছুট, কুতকুত, দারিয়াবান্দা ইত্যাদি। গ্রামীণ খেলা প্রদর্শনের মাধ্যমেও যে আনন্দ প্রকাশ পায় কিশোরী সংগঠনের কিশোরীরা তা সকলকে দেখিয়ে দেয়। তাছাড়া তারা নিজের গ্রামে পাওয়া যায়, বিভিন্ন উৎসবে তৈরি করে, সব সময় খাবার হিসেবে গ্রহণ করে এমন বিভিন্ন ধরণের পিঠা, ভর্তা, শাক, যা’ নিরাপদ, পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ খাদ্য মেলায় প্রদর্শন ও সকলকে পরিবেশ করে। তারা সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে, আচার-অনুষ্ঠানে মেহেদী গাছের সম্পৃক্ততা তুলে ধরে মেহেদী উৎসবের মাধ্যমে। যুবক, কিশোর ও কিশোরীরা প্রত্যেকে হাতে মেহেদী মাখে। ঐতিহ্যের সাথে জড়িয়ে থাকা বাহারী আলপনা আঁকে যুবকরা।
গ্রামীণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি আঙ্গিক হল জারিগান মেলায় পরিবেশিত হয়, যার মাধ্যমে ইতিহাস ও পরিবেশ সম্পর্কে অংশগ্রহণকারীরা জানতে পেরেছেন। গ্রামীণ নাচ ও গানের মাধ্যমে শিক্ষার্থী, যুবক, কিশোর-কিশোরীরা সারাদিন মাতিয়ে রাখে। অনুষ্ঠান/উৎসব সফল করার জন্য সকলের যুক্ততাই ছিল লক্ষ্যণীয়। যুব ও কিশোরীদের এ ধরণের উদ্যোগই পারে সুন্দর সুস্থ সমাজ গড়তে। যুব সমাজের প্রতি পরিবার ও সমাজের মানুষের মনোভাব কিছুটা হলেও পরিবর্তিত হয়েছে।
সকল বিষয়ে প্রতিযোগিতা শেষে যুব সংগঠনের উদ্যোগে বিজয়ীদের মাঝে পুরষ্কার বিতরণ করা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত ঘোষণা করার আগে প্রধান অতিথি চেয়্যারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘গ্রামের ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের এই ধরণের বড় অনুষ্ঠান আয়োজনে আমি খুবই মুগ্ধ। এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। এই ধরণের অনুষ্ঠান আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় উঠেই যাচ্ছে। ঈদ উৎসব আমরা পালন করি তবে সেটা পরিবার ও আত্মীয়স্বজন নিয়ে। কিন্তু গ্রামের সকল শ্রেণী, পেশা ও বয়সের মানুষ মিলেও যে এভাবে আনন্দ ভাগাভাগি করা যায়, তা আমি এদের কাছে প্রথম শিখলাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই গ্রামের যে সমস্ত ছেলে-মেয়েরা স্কুলে পড়ে, তারা বিভিন্ন খেলাধূলায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায়, কিন্তু বড়রা পায়না। নিজের গ্রামে এই অনুষ্ঠান হওয়ার কারণে তারাও অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছে।”
ভবিষ্যতে আরো এরকম আয়োজনে তাঁর পক্ষ থেকে সকল ধরণের সহযোগিতার আশ্বাস ব্যক্ত করে এবং সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।