টিফিনের টাকায় বৃক্ষরোপণ অভিযান
নেত্রকোণা থেকে রুখসানা রুমী
সুস্থ, সুন্দর ও নিরাপদ জীবনযাপনের জন্য চাই সুন্দর পরিবেশ। আর এই পরিবেশ অক্ষুন্ন রাখার দায়িত্ব আমাদের সকলের। আমাদের পরিবেশ আমরাই রক্ষা করতে পারি। এই বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরে পরিবেশ রক্ষার অঙ্গীকার করে নেত্রকোনা জেলার মদনপুর ইউনিয়নের মদনপুর শাহসুলতান উচ্চ বিদ্যালয় এর শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। গত এক বছর ধরে নেত্রকোনা সদর উপজেলা মদনপুর গ্রামের এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন, জেন্ডার সমতা, প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ, পরিবেশ রক্ষায় শিক্ষার্থীদের সচেতনতা বৃদ্ধিতে চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা, সামাজিক সমস্যা চিহ্নিত করণ এবং স্থানীয়ভাবে সমস্যাগুলো সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধকরণে বিষয়ভিত্তিক রচনা প্রতিযোগিতা, ট্রি অলিম্পিয়াড এবং বৃক্ষের গুরুত্ব ও বৃক্ষ রোপণের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে ক্লাশে আলোচনা করার ফলে শিক্ষার্থীরা সচেতন হচ্ছে এবং এ বিষয়ে ধারণা লাভ করে। ফলশ্রুতিতে বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা চলতি মৌসুমে বৃক্ষ রোপণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
সম্প্রতি স্থানীয় জাতের বিষমুক্ত নিরাপদ ফলদ খাদ্য নিশ্চিত করা ও পরিবেশ সুস্থ্য, সুন্দর রাখা এবং জলবায়ু পরির্বতন মোকাবেলায় ওই বিদ্যালয়ের নবম ও দশম শ্রেণীর সকল শিক্ষার্থীরা টিফিনের টাকায় একটি করে ফলদ গাছের চারা রোপণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। সকল শিক্ষার্থী পিতা-মাতার কাছ থেকে বাড়তি টাকা না নিয়ে টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে (খরচ না করে) ১০ টাকা দিয়ে একটি করে ফলদ গাছের চারা কিনে রোপণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। শিক্ষার্থীদের এই মহৎ উদ্যোগ বাস্তবায়নে কাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু বক্কর রহমান ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘বারসিক’র কর্মী রুখসানা রুমী।
রুখসানা রুমী শিক্ষার্থীদের সাথে এক নার্সারি মালিকের যোগাযোগ ও পরিচয় করিয়ে দেন। প্রতিটি চারার বাজার মূল্য ২০ টাকা। বারসিক’র মাধ্যমে যোগাযোগ করায় শিক্ষার্থীরা অন্যান্য নার্সারির তুলানায় প্রতিটি গাছের চারায় ৫ টাকা কম মূল্যে চারা ক্রয় করতে সক্ষম হয়। প্রধান শিক্ষক প্রতিটি চারায় ৫ টাকা ভর্তুকী প্রদান করেন। শিক্ষার্থীরা নার্সারি থেকে চারা সংগ্রহ করে নিজ নিজ বাড়িতে নিয়ে রোপণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্দিষ্ট দিনে নার্সারির মালিক সুরুজ মিয়া শিক্ষার্থীদের চাহিদামত- কাঁঠাল, পেয়ারা, অরবরই, আমলকি, জলপাই ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের দেশীয় ফলদ গাছের চারা স্কুলে নিয়ে আসেন এবং শিক্ষার্থীরা ১০ টাকা করে তাদের পছন্দ অনুযায়ী চারা কিনে নেয়।
এই প্রসঙ্গে স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবুবক্কর রহমান বলেন, “আমাদের পরিবেশ আমরাই রক্ষা করব, দিন দিন দেশীয় ফলের গাছ কমে যাচ্ছে, তাই আমাদের সকলকে বেশি বেশি বৈচিত্র্যময় ফলের গাছ লাগিয়ে পরিবেশকে সুন্দর রাখতে হবে।” শিক্ষার্থীদের এধরণের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে তিনি আরও বলেন, “তোমরাই পারবে পরিবেশকে সুন্দর রাখতে। আমি ৬০ জন শিক্ষার্থীদের বাড়ি যাব, দেখব তোমাদের বাড়ি চারপাশ কেমন। যার বাড়ি চারপাশে অনেক দেশীয় ফলের গাছ আছে এবং বাড়ির পরিবেশ পরিস্কার পরি”্ছন্ন তাদেরকে আমি পুরস্কৃত করব। আজ আমরা সবাই অঙ্গিকার করছি যে, আগামী বছর (২০১৯) শিক্ষক, শিক্ষার্থী উদ্যেগে ও বারসিক’র সহযোগিতায় আমরা ৮০০ শিক্ষার্থীকে দু’টি করে ফলের ও একটি করে ঔষধি গাছ নিমের চারা দিব। আমরা প্রতিবছরই গাছের চারা রোপণ করে এলাকার পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অবদান রাখব।”
বিদ্যালয়ের উদ্যোগী শিক্ষার্থী লিয়া আক্তার বলে, “স্কুল ও গ্রামের পরিবেশ সুন্দর রাখতে আমরা সকলে প্রতিবছরই স্থানীয় জাতের ফল ও ঔষধি গাছের চারা লাগাব। নিজে যেমন লাগাব তেমনি অন্যদেরকেও গাছের চারা লাগাতে উৎসাহিত করব। আগ্রাসী প্রজাতির গাছ লাগাব না, বেশি বেশি ফলের গাছ লাগাব। তাহলেই আমরা গাছ ও পাখি রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারব।’ অন্যদিকে শিক্ষার্থী জয় আহমেদ বলে, “গাছ আমাদের পরম বন্ধ,ু গাছ বড় হবে সাথে সাথে আমরাও বড় হব। এই গাছ বিক্রি করে আমাদের ভাই বোনদের পড়াশুনার খরচ চলবে। আমরা পরিবারের সকলকে নিয়ে দেশীয় নিরাপদ ফল খেতে পারব। নিরাপদ ফল খেয়ে আমাদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ হবে, নিজে ভালো থাকব এবং অন্যদেরও ভালো রাখতে পারব।’
মদনপুর শাহসুলতান উচ্চ বিদ্যালয় এর শিক্ষার্থ ীদের টিফিনের টাকায় বৈচিত্র্যময় ফলদ গাছের চারা রোপণের উদ্যোগটি সত্যিই প্রশংসনীয়। দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের উচিত পরিবেশ সুরক্ষায় বৃক্ষ রোপণের এমন উদ্যোগ গ্রহণে এগিয়ে আসা। প্রতিটি স্কুলের শিক্ষার্থীরা যদি স্কুলের ক্যাম্পাস ও নিজ নিজ বাড়ির খালি খোলা পতিত জমিগুলোতে পরিবেশবান্ধব বৈচিত্র্যময় ফলদ গাছের চারা রোপণ করে তাহলে পরিবেশ যেমন সুষ্ঠু, সুন্দর, মনোরম ও নিরাপদ হবে, তেমনি আমাদের জীবনযাপনের নিরাপত্তার সুনিশ্চিত হবে।