হাতের ভাজা মুড়ি
নাচোল চাঁপাই নবাবগঞ্জ থেকে অনিতা বর্মণ
চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়ন পরিষদে অবস্থিত টিকইল গ্রামের বাসিন্দা শ্রীমতি ভারতী রাণী (৪০)। তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৪ জন। সব মিলে বসতভিটা ১০ শতক। স্বামী দিনমজুরি করে যা পান তাতে করে কোন রকমে সংসার চলে যায়। বছরে ৩ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে তাতে ধান, গম, সরিষা, মসুর, মটর, পেঁয়াজ, রসুন চাষ করে থাকেন ভারতী রানী । তাছাড়া তিনি তার বাড়ির উঠানে চাল কুমড়া, শিম, পুইশাক, লাউ, মিষ্টি কুমড়া চাষ করে পরিবারের সবজি চাহিদা পুরণ করে থাকেন। ভারতী রানী নিজ উদ্যোগে ছোট-বড় মিলে ৩৫টি মুরগি, ৫টি রাজহাঁস, ৮টি পাতি হাঁস এবং একটি গরু লালন পালন করেন। ভারতী রাণী সংসারের স্বচ্ছলতা আনার জন্য এবং ছেলে-মেয়েদের লেখাপাড়ার খরচ জোগার করার জন্য মুড়ি ভাজা শুরু করেন। ছোট বেলায় মায়ের কাছ থেকেই তিনি মুড়ি ভাজার কৌশল শিখেন বলে জানান। তিনি বলেন, “ছোটবেলায় দেখতাম মা মুড়ি ভেজে আর বাবা কৃষি কাজ করে সংসার চালাতেন, চালাতেন আমাদের ভাই -বোনদের লেখাপড়ার খরচ। মাকে সহযোগিতা করতে করতে নিজেও শিখে নিলাম মুড়ি ভাজার কাজ। মায়ের হাত ধরেই হাতে ভাজা মুড়ি ভেজে সংসার জীবনে সংগ্রাম করে চলছি ”।
তিনি আরও বলেন, “প্রায় ১৮ বছর ধরে মুড়ি ভেজে সংসারের টুকিটাকি খরচ এবং ছেলে মেয়েদেরও লেখাপড়ার খরচ চালাতে পারছি। দেখেছি বছর কয়েক আগেও টিকইল গ্রামের নারীরা হাতে মুড়ি ভেজে সংসারে মুড়ির চাহিদা পূরণ করে থাকত। কিন্তু বর্তমানে মেশিনের মুড়ির দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহি হাতে ভাজা মুড়ি”।
তারপরও বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবে যেমন : পূজা, হরিবাসর, রমজান মাসে তারা হাতে ভাজা মুড়ি করে থাকেন ভারতী রাণী। তবে শীতের আগমন বার্তার আগেই হাতে ভাজা মুড়ির কদর বেশি বেড়ে যায় বলে তিনি জানান। হাতে ভাজা মুড়ি অনেক স্বাস্থ্যসম্মত। তাই খরচ বেশি হলেও গিরস্ত (কৃষি জমির মালিক) মানুষেরা হাতে ভাজা মুড়িই খান। হাতে ভাজা দেশী ধানের মুড়ির স্বাদ মিষ্টি। হাতে মুড়ি ভাজার উপকরণ চাল, বালু, জ্বালানি, কড়াই, হাড়ি, বাঁশের তৈরি মোটা ও মিহি করে কাটা খুচি ।
ভারতী রানী জানান, গিরস্ত ১২ কেজি ধান দিলে তাকে ৪ কেজি মুড়ি দেওয়া হয়। মালিকের কাছ থেকে ১২ কেজি ধান সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাত করে ৮ কেজি চাল পাওয়া যায়। এরপর সেই চাল ভেজে ৪ কেজি মুড়ি মালিকদের দেওয়া হয় আর বাকি ২ কেজি মুড়ি থাকে আর তাতে করে পরিবারের মুড়ির চাহিদাটা পূরণ করা হয় ।
ভারতী রানী বলেন, “আমি বছরে প্রায় ১৩/১৪ মণ ধান প্রক্রিয়াজাত করে হাতে মুড়ি ভেজে থাকি। গ্রামের মানুষ এবং পার্শবর্তী গ্রামের কিছু মানুষ এখনো হাতে ভাজা মুড়ি খেয়ে থাকেন। আর তারাই আমার কাছে মুড়ি ভেজে নেয়। এই মানুষগুলোই হাতে ভাজা মুড়ি শিল্প বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন।”
ভারতী রাণী আরও বলেন, “কালের বিবর্তনে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যময় অনেক কিছুই হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে আমার স্বপ্ন আমি যতদিন ভালো থাকবো ততদিন হাতে ভাজা মুড়ি ভাজব আর অন্যদের উৎসাহিত করব এই মুড়ি খেতে।”