রঙিন পাখায় স্বপ্ন ওড়ে —

আব্দুর রাজ্জাক, ঘিওর, মানিকগঞ্জ

প্রজাপতি! প্রজাপতি!
কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন পাখা,
টুকটুকে লাল-নীল ঝিলিমিলি আঁকা-বাঁকা।
—জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রজাপতির নানা রঙের বিচিত্র রূপে মুগ্ধ হয়েই এ গানটি লেখেন।

… ওই সুদূর নীল আকাশ থেকে জমিন; যে দিকে চোখ যায় সর্বত্রই স্রষ্টার সৃষ্ট প্রকৃতির রূপে আকৃষ্ট হয় মানুষ। প্রকৃতির মুগ্ধতায় ভরিয়ে দেয় মন। আর প্রজাপতিকে বলা হয় প্রকৃতির অলঙ্কার। রঙ বেরঙের কতই না প্রজাপতি। যেন পাখায় আঁকা রংধনুর সব রঙের স্বপ্নীল মেলবন্ধন। পৃথিবীর সব ধরনের পোকামাকড়ের মধ্যে প্রজাপতিই সবচেয়ে রঙিন এবং স্পন্দনশীল। গ্রিকরা মনে করেন, প্রজাপতি মানে হলো মৃত আত্তার প্রতীক। অনেক জায়গায় কবরের ফলকে প্রজাপতির চিত্র আঁকা থাকে। রোমানিয়াদের বিশ্বাস, প্রাচীনকালের কোনো দেবদেবীর চোখের পানি থেকে প্রজাপতির সৃষ্টি। ফুল থেকে ফুলে, সমতল কিংবা পাহাড়ে, ঝোপে-ঝাড়ে, বাড়ির আঙিনার গাছপালায়, নদীর কিনার থেকে গাছ পেরুনো উঁচুতে এদের ছুটে চলা মানুষের মনে খুশির দোলা দিয়ে যায়।

প্রজাপতি Lepidoptera বর্গের বড় আকারের আকর্ষণীয় রঙের শীতল রক্তযুক্ত পতঙ্গ। লেপিডুপেটরা একটি গ্রীক শব্দ যা দিয়ে “মাপযুক্ত পাখনা’’ বুঝায়। সাধারণত প্রজাপতির শরীর লম্বাটে, উজ্জ্বল রঙের, উড়ে দিনের বেলা। তাপমাত্রা ৮২-১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের মধ্যে থাকলে প্রজাপতি খুব সহজেই চলাফেরা করতে পারে। প্রজাপতির ঘ্রাণ ও দৃষ্টিশক্তি অত্যন্ত প্রখর, যা দিয়ে সে অনেক দূর থেকেই কাঙ্খিত ফুলের গন্ধ এবং রং নিরূপণ করতে পারে।
ghior-manikgonj-pic-%e0%a7%a7
প্রজাপতি বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, প্রজাপতিরা সাধারণত ১২টি গোত্রে বিভক্ত। সারা পৃথিবীতে কয়েক হাজার প্রজাতির প্রজাপতি রয়েছে। বাংলাদেশে প্রায় ৪০০টি বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতি চিহৃত করা গেছে বলে জানা যায়। পা গুলোকে ব্যবহার করে প্রজাপতি কোনো উদ্ভিদ বা বিভিন্ন খাবার খুঁজে বেড়ায়। এ পতঙ্গটি সাধারণত ফুলের মধু খেয়ে বাঁচে। তবে এদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে ফুলের রেণু, গাছের রস, পচা ফল, গোবর, পচনশীল মাংস অথবা ময়লায় দ্রবীভূত অবস্থায় থাকা খনিজ পদার্থ। প্রজাপতি বিভিন্ন গাছের ফুলকে জড়িয়ে ধরে এর রস আস্বাদন করে থাকে। এদের মেরুদন্ডের কাছে একটি কেমোরেসিপট রস থাকে যা বিভিন্ন গাছের রাসায়নিক পদার্থের কোনো মিল খুঁজে পেলে সেখানে সে তার ডিমগুলো স্থাপন করে যায়। প্রজাপতির পাখাগুলো আসলে এক ধরনের চিটিন নামক প্রোটিনের স্তর দিয়ে তৈরি, যেগুলো প্রাণীটিকে উড়তে সহায়তা করে। হাজার হাজার হালকা তুলার মতো পদার্থ স্বচ্ছ চিটিনের চারপাশে বেষ্টন করে থাকে, আলো পড়লে তা প্রতিফলিত হয়ে বিভিন্ন রঙের তৈরি করে। এরা সাধারণত ঘণ্টায় ১২ মাইল থেকে ২৫ মাইল বেগে উড়তে পারে। পূর্ণবয়স্ক শুঁয়াপোকা পিউপায় পরিণত হওয়ার পর এক সপ্তাহ থেকে কয়েকমাস উপ্তিকাল কাটিয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রজাপতি হয়ে উড়াল দেয়। গোটা জীবনচক্রের দৈর্ঘ্য প্রজাতি ভেদে ভিন্ন ভিন্ন। একটি প্রজাপতির আয়ু মোটামুটি ২-৪ সপ্তাহ। এতটুকু সময়ের মধ্যে তারা শুধু দুটি কাজই করে থাকে- খাওয়া এবং প্রজনন করা।

গুরুত্বপূর্ণ প্রজাপতির গোত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে সোয়ালোটেইলস, লেমন বাটারফ্লাই। | Pieridae গোত্রের প্রজাপতি সারাদেশে বিস্তৃত। প্রজাপতি অনেক জাতের ফুলের পরাগযোগ ঘটায়। তবে কিছু প্রজাপতি ফল ও ফসলের ক্ষতিকর পতঙ্গের দলভুক্ত। বাংলাদেশে যে সমস্ত প্রজাপতি আছে তার মধ্যে হিসপিরিডাই, পেলিপনডাই, পেরিডাই, নীমফেলিডাই, ঢানিডা, সেটিরাইড, লিসানিডাই, এমাথুসাইডি, এক্রিডাই, ব্যামবো ট্রি ব্রাউন, প্লেইন টাইগার, কমন ডাফার এবং রিউডিনাই উল্লেখযোগ্য।

২০১০ সাল থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রজাপতি সেন্টার অ্যান্ড এক্সিবিশনে “প্রজাপতি সংরক্ষণ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা” গড়ে তোলার জন্য প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় প্রজাপতি মেলা। প্রজাপতি প্রদর্শনের জন্য এখানে একটি অস্থায়ী প্রজাপতি শেল তৈরি করা হয়। এটা মুলত করা হয় জনগনের সচেতনতার জন্য।  জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যার অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন সম্প্রতি একটি পত্রিকায় সাক্ষাতকারে বলেন, দেশের প্রাণিকূলের সর্বশেষ বিলুপ্তির হুমকির তালিকায় ১৮৮টি প্রজাপতিতে চিহ্নিত করেছি আমরা। এর মধ্যে একটি মহাবিপন্ন, ১১২টি বিপন্ন ও ৭৫টি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বিপন্নের তালিকায় রয়েছে সোনালি পাখার ‘কনকচাপা’ (বৈজ্ঞানিক নাম- Troides aeacus), সাদা বাঘ নামে পরিচিত ডোরা কাটা ‘সুষমা’ (বৈজ্ঞানিক নাম-Danaus melanippus), রঙিন গোলাপ নামে পরিচিত ‘আলসিন্দুরা’ (বৈজ্ঞানিক নাম- Pachliopta hector) এবং কমনবার্ড নামে পরিচিত ‘সোনাল’ (বৈজ্ঞানিক নাম- Troides helena)।

প্রজাপতি রপ্তানি করে প্রতিবছর মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, ইংল্যান্ড কয়েক মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করছে। প্রজাপতি নিয়ে রয়েছে হাজারো কাহিনী, কবিতার উপমা, সৌন্দর্য্যরে তুলনা ও লোকগাঁথা।

কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয়, মানব সৃষ্ট প্রকৃতির ধ্বংস-অবকাঠামো পরিবর্তন, নগরায়ণ, নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, বনভোজন, চিত্র ধারণ কর্মকান্ড, দর্শনার্থীদের সৃষ্ট শব্দ দূষণ ইত্যাদি কারণে প্রতিনিয়ত প্রজাপতির জীবনকে করে তুলছে বিপন্ন। প্রকৃতির এ নিষ্পাপ সৌন্দর্য্যরে প্রতীক প্রজাপতিকে টিকিয়ে রাখতে গণসচেতনার বিকল্প আর কিছু নেই।

happy wheels 2