চরাঞ্চলে শিক্ষার আলো ছড়ালেন আশরাফ হোসেন চৌধুরী
হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ থেকে মুকতার হোসেন
কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়ে তাঁদের কাজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর জন্য মানুষ পছন্দের কোন একটি কাজ বেছে নেন। কেউ ব্যবসা, চিকিৎসা, দোকানপাট, মিল ফ্যাক্টরীসহ নানা রকম কাজ। অথবা চাকুরী জীবনের অবসরকালীন ভাতা দিয়ে বাকী জীবনটাকে আরাম আয়েশে খেয়ে পড়ে কাটিয়ে দেয় বাকী জীবনটাকে।
মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার প্রত্যান্ত চরাঞ্চলে লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নে গঙ্গাধরদি গ্রামে বাড়ি আশরাফ হোসেন চৌধুরীর (রবিন)। হরিরামপুর উপজেলা থেকে এক ঘণ্টা নৌকা যোগে পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে পায়ে হেটে, শুকনা মৌসুমে ঘোড়ার গাড়ি, মোটরসাইকেল, বর্ষার সময় নৌকা যোগে ৫ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে গঙ্গাধরদি গ্রামে যেতে হয়। বাপ দাদার চরাঞ্চলে অনেক জমিজমা রয়েছে। ছোট বেলা থেকেই মাতৃভুমির প্রতি ছিল তার গভীর ভালোবাসা। সেনাবাহিনীর অডিড শাখায় কর্মজীবন শেষ করে ফিরে আসেন গ্রামের বাড়িতে, তাঁর বাপ-দাদার পৈতৃক ভিটায়। নিজের সুখের চিন্তা না করে তার সারা জীবনের কষ্টে অর্জিত অবসরকালীন ভাতার টাকা দিয়ে এলাকার শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে পৌছিয়ে দেওয়ার জন্য গত পহেলা জানুয়ারি ২০১২ সালে নিজের পৈতিৃক জায়গায় ১৫ হাত একটি চার চালা ঘর দিয়ে তার দাদার নামে “কুটি মিয়া স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়” গড়ে তোলেন।
স্কুলটি প্রতিষ্ঠালগ্নে বুদ্ধি,পরামর্শ দিয়ে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেন বিচারপ্রতি নুরুল ইসলাম ডিগ্রী কলেজের সহাকারী অধ্যাপক আহম্মেদ হোসেন (পিন্টু)। পাশের নটাখোলা গ্রামের আব্দুল ছালাম নামে একজন শিক্ষক নিয়ে স্কুল কার্যক্রম শুরু করেন। আশরাফ হোসেন চৌধুরী নিজে চরে অবস্থান করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নিয়মিত দেখাশুনা করতেন। দিন যায় আস্তে আস্তে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। নিজের উপার্জিত টাকা দিয়ে স্কুলের নিচু জায়গা মাটি ভরাট করে জায়গা সম্প্রাসারণ করে চারপাশে ইটের দেওয়াল দিয়ে বেড়া দেন। লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের নটাখোলা গ্রামে যাওয়ার পথে রাস্তার পাশে একটি মনোরম পরিবেশে গড়ে তুলেছেন এই স্কুলটি। বর্তমানে কুটি মিয়া স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১ম শ্রেণী থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদান করা হয়। বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে গঙ্গাধরদি, বালিয়াচর, হরিহরদিয়া, নটাখোলা ও পাটগ্রামচর গ্রামের ২২৫ জন শিক্ষার্থী অধ্যায়নরত রয়েছে।
৫ জন শিক্ষক এই স্কুলে নিয়মিত পাঠদান করেন। স্কুলটিতে ৫টি ক্লাসরুম, একটি শিক্ষকদের রুম এবং অতিথিদের জন্য আবাসিক রুম ও একটি ষ্টোর রুম রয়েছে। একটি টিউবওয়েল এবং ছেলে ও মেয়েদের জন্য রয়েছে আলাদা ২টি টয়লেট রয়েছে। স্কুলটির পিছনে রয়েছে একটি পুকুর ছাত্রদের সাঁতার শেখানোর বিষয়টি মাথায় রেখে পুকুরটি তৈরি করা হয়েছে। স্কুলের বাউন্ডারী ভিতরে এবং চারপাশে রয়েছে আম, কাঁঠাল, জলপাই, চালতা, পিয়ারাসহ নানা ফলমুলের গাছ। ২০১৪ সালে প্রথম আলো বন্ধু সভা, উত্তরণ এবং বারসিক ২০০ ফলজ গাছের চারা দিয়ে সহযোগিতা করে। এই চারাগুলো স্কুলের চারদিকে রোপণ করা হয় সে সময়।
২০১৬ সালে সমাপনী পরীক্ষায় এই স্কুলের শিক্ষার্থী আমেনা আক্তার ৪.৮৩ পেয়ে কেন্দ্র প্রথম হয় এবং এ পর্যন্ত ৬ জন শিক্ষার্থী স্কুলটি থেকে বৃত্তি পেয়েছে। বার্ষিক সমাপনী অনুষ্ঠান, প্রতিষ্ঠাতা বার্ষিকী, বিভিন্ন সরকারি দিবস, উৎসব পালন করে থাকে এই স্কুলের শিক্ষার্থীরা। এই স্কুলের শিক্ষকদের সম্মানীও সন্তোষজনক। এছাড়া শিক্ষকের ঈদ উৎসব ভাতা দেওয়া হয়।
গঙ্গাধরদি গ্রামের মো. সোরহাব উদ্দিন বলেন, “কুটি মিয়ার স্কুলের শিক্ষকরা নিজ এলাকার হওয়ার কারণে স্কুলে সময় বেশি দেয়। ফলে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ভালো হয়।” স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুস ছালাম বলেন, “আমরা সামান্য সম্মানী ভাতা নিয়ে শিক্ষকতা করি, যাতে চরাঞ্চলে শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে পৌছে যায়। এছাড়া স্কুলে লেখাপড়ার পাশাপাশি বাড়িতে অভিভাবকদের তাগিদ দিতে হবে।” স্কুলের সমস্যা বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক আরও বলেন, “আরও একটি ক্লাসরুম বৃদ্ধি করা দরকার। শ্রেণী কক্ষে কয়েক জোড়া বেঞ্চ এবং অফিসিয়াল কাগজ পত্র রাখার জন্য একটি আলমিরা প্রয়োজন।”
কুটি মিয়া স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা আশরাফ হোসেন চৌধুরীর সাথে আলোচনা করে তিনি বলেন, “আমার এখন অনেক বয়স হয়েছে। নিজ অর্থ ব্যয়ে স্কুলটি পরিচালনা করা আমার পক্ষে খুবই কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। যদি স্কুলটি সরকারিকরণ করা হয় তাহলে বিদ্যালয়টি থেকে হাজারো আলোর প্রদীপ জ্বলবে। এছাড়া এই বিদ্যালয় থেকে পাশ করে বের হয়ে আরও উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করবে। সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করবে। দেশ সেবার কাজে নিজেকে আত্মনিয়োগ করবে।” তিনি আরও বলেন, “কেউ নিজ এলাকয় ফিরে এসে বাড়িতে ভাত খেয়ে শিক্ষকতা করবে, কেউ অন্যান্য চাকুরী ও সেবামুলক কাজ করবে। ভবিষ্যতে তিনি কম্পিউটার এর মাধ্যমে ডিজিটাল শিক্ষার আওতায় যুক্ত করতে চান। হরিরামপুর উপজেলা সহাকারী শিক্ষা অফিসার নায়েব আলী বলেন, “লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের গঙ্গাধরদি গ্রামে কুটি মিয়া স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির কাগজপত্র জেলা শিক্ষা অফিসের মাধ্যমে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করা হয়েছে। সরকারিকরনের জন্য স্কুলটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।”
শিক্ষানুরাগী আশরাফ হোসেন চৌধুরীর এই মহতি উদ্যোগ চরাঞ্চলে মানুষের জীবনযাত্রারমান উন্নয়নে ইতিবাচক পরিবর্তনে ভুমিকা রাখবে। সেই সাথে চরে ঘরে ঘরে জ্বলে উঠবে শিক্ষার আলো, থাকবে না যৌতুক, বাল্য বিবাহ, তরুনরা গড়বে মাদক মুক্ত সমাজ, আলোকিত হবে সমাজ, গড়ে উঠবে সুন্দর বাংলাদেশ। চরবাসীর এটাই প্রত্যাশা ।