একজন হযরত আলীর একাগ্রতা ও সংকল্প
কলমাকান্দা, নেত্রকোনা থেকে মুন্না রংদী
কলমাকান্দা উপজেলার লেঙ্গুরা ইউনিয়নের তারানগর গ্রামে বাস করেন হযরত আলী। বয়স ২৩ বছর। তারা ৪ ভাই ১ বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। তার ২ ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে। এখন তারা নিজ নিজ সংসার নিয়েই ব্যস্ত।
হযরত আলীর বাবা কাঞ্চন মিয়া এবং মা আয়েশা খাতুন । পারিবারিক আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। তাদের আবাদী কোন জমিও নেই। শুধু রয়েছে থাকার মত প্রায় ২৪ শতাংশ জায়গা। বাবা দিন মজুরি ও লাঙ্গল, মই তৈরি করে বাজারে বিত্রিæ করেন। যা আয় হয় তা দিয়ে কোন রকম সংসার পরিচালনা করতেন।
৫ ভাই বোনের মধ্যে হযরত একজন মেধাবী ছাত্র ছিলো। তিনি ৫ম শ্রেণীতে বৃত্তিও পেয়েছেন। তাই তার অভিভাবকদেরও তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেন। তাঁর মা হাঁস-মুরগি পালন, ডিম, কুড়া ও কয়লা বিত্রিæ করে হযরতের পড়াশুনায় সহায়তা করতেন। এমন করেই চলছিল তার লেখাপড়া। একদিন খেলতে গিয়ে পায়ের মধ্যে কাটা বিঁধে যায়। ধারণা করা হয়েছিল, সেটি বড়ই গাছের কাটা। তাই তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। পরে আস্তে আস্তে ক্ষত স্থানটি ইনফেকশন হতে শুরু করে। তার এক পর্যায়ে তা ধনুষ্টংকারের রূপ ধারণ করে এবং ২-৩ বছর অনেক ভোগান্তিতে ভুগতে হয় তাকে। ডাক্তার ও কবিরাজের চিকিৎসার পর কিছুটা সুস্থ হন। তবে সুস্থ হলেও একসময় দেখা যায় তার বাম পা আস্তে আস্তে ছোট হতে থাকে। যার ফলে তিনি আগের মত হাটাচলা করতে পারলেন না। ফলে এখন তিনি ত্রæ্যাচে ভর দিয়ে চলাফেরা করছেন।
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2020/01/73293948_2730680510283648_8384761461649440768_n.jpg)
এমনিতেই তাদের পরিবারের অভাব ঘুচায় না তারপর আবার তা চিকিৎসার খরচ। সব মিলিয়ে তার পরিবারের খরচ আরো বেড়ে গেল। তবে এত কিছুর পরও হযরতের মনে একটাই প্রতিজ্ঞা ছিল যে, তিনি কখনো লেখাপড়া ছাড়বেন না। লেখাপড়া চালিয়ে যেতে থাকলেন। ৫ম শ্রেণী পাশের পর হযরত প্রতিবন্ধী ভাতা পেয়ে একটি ছাগল কিনেন। পরবর্তীতে ছাগলটি ২টি বাচ্চা দেয়। বাচ্চা ও মাসহ তা বিত্রি করে গ্রামে বাড়ির এক কোণে ছোট্ট পরিসরে একটি মুদির দোকান দেন। তখন তিনি ৭ম শ্রেণীর একজন ছাত্র ছিলেন।
বারসিক ২০১৩ সালে তাঁর দোকানের জন্য কিছু মালপত্র যেমন: তৈল, ডাল, মুড়ি, চানাচুর, সাবান, বিস্কুট ইত্যাদি কিনে দেওয়া হয়, এতে তার অনেক উপকার হলো। এভাবে তাঁর ব্যবসা ভালো হতে থাকে। দোকান করার পাশাপাশি তিনি শুরু করেন প্রাইভেট পড়ানো। দোকান ও প্রাইভেট পড়িয়ে যে টাকা তিনি আয় করতেন সেটা দিয়ে তার নিজের লেখাপড়া ও পরিবারের খরচ চালাতে থাকেন।
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2020/01/74587481_569167197160056_1952951277650444288_n.jpg)
এস.এস.সি পাশ করার পর বাজার সমিতিতে যোগ দান করেন। বাজার সমিতিতে তাকে সম্পাদকের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ৩-৪ বছর পর তিনি সমিতি থেকে কিছু টাকা ঋণ গ্রহণ নিয়ে লেংগুড়া বাজারে ভাই ভাই স্টোর নামে একটি কসমেটিক দোকান খোলেন। এর মাঝে যখন সময়ই পান তখনই বই নিয়ে লেখপড়া করেন। বর্তমানে তিনি বি.এ শেষ বর্ষের পরীক্ষা শেষ করেছেন। তাঁর স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার স্বপ্ন বা প্রত্যাশা হলো লেখাপড়া শেষ করে কোন একটি চাকুরি করব। এতদূর পর্যন্ত যখন আসতে পেরেছি তাহলে আরো অনেকদূর যেতে পারবো বলে আমি বিশ্বাস করি।’
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2020/01/Untitled-1-1024x777.jpg)
তাঁর মা আয়েশা খাতুন কাঁদ কাঁদ স্বরে বলেন, ‘আমাদের অসচেতনতা ও ছোট ভুলের কারণে আমাদের ছেলে আজ প্রতিবন্ধীত্ব জীবনযাপন করছে। আরও ভালো চিকিৎসা করার মত আমাদের সামর্থ্য ছিলনা। তবে বর্তমানে আমরা আগের চেয়ে অনেক ভালো আছি। আমাদের ভালো থাকার জন্য হযরত আলীর অবদান অনেক।’