লবণাক্ততায় বৈচিত্র্যময় ফসল চাষে সফল কমলা ও সুনিতা রানী

শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
‘আমাদের চারিদেকে পানি আর পানি কিন্তু তা হলো লবণ পানি, যা ব্যবহার উপযোগী নয়। আমাদের এই গ্রামের নাম পূর্ব কালিনগর। গ্রামের একপাশে মালঞ্চ নদী আর অন্যপাশে লবণ পানির চিংড়ির ঘের। দুপাশের এই লবণ পানির মাঝখানে আমাদের বসবাস। প্রতিনিয়তই লবণ পানির সাথে আমাদের সংগ্রাম করতে হচ্ছে। এই লবণ পানির মধ্যে দিযে আমরা আমাদের সংসাবের চাকাকে সচল রাখার জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কখনো ব্যক্তি বা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় পুকুর খনন করে মিষ্টি পানি সংরক্ষণের চেষ্টা করি। কখনো লবণ সহনশীল গাছের চারা লাগানো। আবার কখনো সবজি চাষের উপযোগী পরিবেশ তৈরির জন্য নানান ধরনের কৌশল ও উদ্যোগ গ্রহণ করার চেষ্টা করি। কখনো বিভিন্ন জাতের হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল ও ভেড়া পালন করি। আবার পুকুরগুলোতেও লবণাক্ততায় টিকতে পারে সেরকম মাছ চাষ করি। এভাবেই আমাদের চেষ্টা চালিযে যেতে হচ্ছে অবিরত।’


উপরোক্ত কথাগুলো বলেছেন শ্যামনগর উপজেলা মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের পুর্ব কালিনগর গ্রামের কৃষাণী কমলা রানী ও সুনিতা রানী মন্ডল। মাঠ পর্যবেক্ষণে লবণাক্ততা পরিবেশের মাধ্যমে কিভাবে ফসল উৎপাদনের চেষ্টা করছেন সে বিষয় পারস্পারিক আলোচনায় এ কথাগুলো বলেছেন তারা।
কমলা রানী ও সুনিতা রানী বলেন, ‘আমাদের এলাকায় মূল সমস্যা হলো লবণ পানি। এই পানির সাথে আমাদের লড়াই করে পানিকে কেন্দ্র করে নানান ধরনের কৌশল ও উদ্যোগ গ্রহণ করতে হয়। আমাদের এখানে প্রায় বাড়িতে কিন্তু সবজি চাষ হয়। বিভিন্ন ধরনের হাঁস-মুরগি পালন করি। লবণের মধ্যে সমস্যা হয়। তারপরও নিজেদের মতো করে সবাই কম বেশি চেষ্টা করি। কারণ আমাদের গ্রামের অধিকাংশ পরিবার দরিদ্র। এখানকার মানুষের প্রধান প্রধান কাজ হলো যোন-মজুরি, চিংড়ি ঘেরে মাছ চাষ, নদীতে মাছ ধরা, এলাকার বাইরে ধান কাটা ও ইটের ভাটা এবং সুন্দরবনের বিভিন্ন সম্পদ আহরন করা।’


তারা আরো জানান, ‘আমাদের এলাকা দুর্যোগ প্রবণ। এখানে প্রতিবছর নানান ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়ে থাকে। এছাড়াও নদীর পাশে বসবাস হওয়ায় দুর্যোগে এলাকায় সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে থাকি আমরা। এখানে যেমন আছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ তেমনি লবণাক্ততার সাথে আছে জলাবদ্ধতা। যেমন তেমন বৃষ্টি হলে চিংড়ি ঘেরের যে নাইনটি আছে তাতে পানি ঠিকমতো বের হতে পারেনা ফলে বড় ধরনের জলাবদ্ধতা মুখে পড়তে হয়।’ তারা জানান, ‘এরকম নানান প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিযে পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে। আমরা বসতভিটায় নানান ধরনের সবজি ফসল চাষবাদ করছি। বছরের প্রায় সময় কম বেশি করে আমাদের বাড়িগুলো সবজি ও মসলা থাকে। এখন আমাদের খেতে লালশাক, পালনশাক, মূলা, বীটকপি, ওলকপি, গাজর, শিম, ওলকপি, পাতাকাপি, ফুলকপি, ধনিয়া, বেগুন,আলু, টমেটো, বড় আলু, উচ্ছে, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, শসা, পেঁপে, কলা ইত্যাদি আছে। এছাড়াও তাদের বাড়িতে বিভিন্ন ধরনরে প্রাণী সম্পদ পালন করছেন, ঘের ও পুকুরগুলোতে হরেক রকমের মাছ চাষ করছেন। বসতভিটায় ফলজ গাছ হিসাবে কদবেল, ছবেদা, নারকেল, কলা, খেজুর, পেয়ারা, আমড়া, কুল, ডালিম এবং কাঠ জাতীয় গাছ নিম, মেহগনি, শিশু, কেওড়াসহ বিভিন্ন বনজ গাছ রোপণ করছেন। এতে করে আমরা কম বেশি সংসারের প্রযোজন মিটিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।’


কমলা ও সুনিতা রানী জানান, নারীরা বাড়িতে ফসল উৎপাদনের কাজটি বেশি করেন এবং পরিবারের অন্য সদস্যরাও তাদের এ কাজে সহায়তা করেন। এখান থেকে কয়েকবছর আগে বারসিক থেকে পরিবেশবান্ধব চুলা তৈরির প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং সে চুলা অনেকেই ব্যবহার করছেন। এছাড়াও গ্রাম পর্যাযে আলোচনায় সবজি চাষের বিভিন্ন পরামর্শ গ্রহণ করেন। তারা বলেন, ‘আমরা নারীরা একত্রিত হয়ে একটি সংগঠন তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি।’


বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকুলীয় অঞ্চলে লবণক্ততার পরিমাণ একটু বেশি। যার জন্য ইচ্ছা করলেই সব সময় সবকিছু চাষ করা সম্ভব হয় না। তারপর উপকূলবাসী প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে খাপ-খাইয়ে নিয়ে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে বিভিন্ন ভূমিকা পালন করে চলেছেন। তার উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হলো কমলা রানী ও সুনিতা রানীর মত নারীরা।

happy wheels 2

Comments