মানিকগঞ্জের ভাষা সংগ্রামের জীবন্ত কিংবদন্তি: আব্দুল হাকিম মাস্টার ও মিরান উদ্দিন মাস্টার
মানিকগঞ্জ থেকে নজরুল ইসলাম ও কমল চন্দ্র দত্ত
পৃথিবীর ইতিহাসে ভাষার জন্য লড়াই করে জীবন দান ও মাতৃভাষাকে রক্ষা করার গৌরবান্বিত ইতিহাস কেবল আমাদেরই (বাঙালি) রয়েছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস হিসেবে পরিচিত হলেও আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাবেশ থেকে। উর্দু ভাষাকে নিয়ে যারা দাম্ভিকতা করেছিল তাদের সমুচিত জবাব দিয়েছিল এ দেশের ছাত্র সমাজ। সেই আন্দোলনের অগ্নি শিখা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজপথ এবং জেলা ও মফস্বলেও ছড়িয়ে পড়ে।
তারই ধারাবাহিকতায় মানিকগঞ্জেও ভাষা আন্দোলন সংগঠিত হয়। সূত্রপাত হয় প্রথম তেরশ্রী কে. এন. ইনিস্টিউট থেকে। মূলত ই বিদ্যালযের সহকারি প্রধান শিক্ষক প্রমথনাথ নন্দী ছিলেন ভাষা আন্দোলনের পুরোধা। তার আদর্শে প্রভাবিত হয় তাঁর বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীবৃন্দ। তিনি এবং তার একনিষ্ঠ কয়েকজন শিক্ষক, সহকর্মী ও ছাত্রদের নিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিছিল বের করেন। সেই মিছিলে পুলিশ বাধা দেয় এবং কয়েকজনকে কারা বরণ করতে হয়। সারাদেশের বিভিন্ন এলাকার এ রকম খন্ড খন্ড রূপই বাংলার ভাষা আন্দোলন। যার আন্দোলনের চুড়ান্ত রূপ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি’র আন্দোলনের মাধ্যমে বিজয় সূচিত হওয়া।
প্রতি বছরের ন্যায় এবারও মানিকগঞ্জের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করলো শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বারসিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবী সংঘ (সাবিস) এর যৌথ আয়োজনে শহীদ দিবসের অনুষ্ঠান মালার মধ্যে রয়েছে-প্রভাত ফেরীতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শনী, ভাষা সংগ্রামীদের সম্বর্ধনা ও আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সাবিস মিলনায়তনে ভাষা সংগ্রামীদের সম্বর্ধনা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বীর মুক্তিযোদ্ধা রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ পান্নুর সভাপতিত্বে বক্তারা বলেন, “আমরা গভীরভাবে শ্রদ্ধা জানাই ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামীদের। আজকে জীবিত দু’জন ভাষা সংগ্রামীর মাধ্যমে সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে-এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও স্মৃতিকথা তুলে ধরেন জীবন্ত কিংবদন্তি ভাষা সংগ্রামী মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আব্দুল হাকিম মাস্টার। তিনি বলেন, “আমাদের নেতা ছিলেন তৎকালীন আন্দোলনের পুরোধা প্রয়াত প্রমথনাথ নন্দী। তার উৎসাহ আর উদ্দীপনায় আমরা ভাষা আন্দোলনে যোগদান করি। স্লোগান দেই, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’; ‘উর্দু ভাষা চলবে না’। তিনি আরো বলেন, “আন্দোলনে আমাদের সাথে যারা ছিলেন-যতদূর মনে পড়ে- তেরশ্রী কে. এন. ইনিস্টিটিউট এর সহকারি প্রধান শিক্ষক প্রয়াত প্রমথনাথ নন্দী, ক্রীড়া শিক্ষক আফসার উদ্দিন আহমেদ, কলেজ শিক্ষার্থী প্রমথনাথ সরকার, মোবারক আলী, ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র আব্দুস সালাম। ওই বিদ্যালয়ের ম্যাট্রিক পরিক্ষার্থী আব্দুল হাকিম, আব্দুর রহমান ঠাকুর, মনিন্দ্র নাথ সরকার, সিরাজ উদ্দিন মৃধা; নবম শ্রেণীর ক্যাপ্টেন মিরান উদ্দিন, ছাত্র মো. ওয়াজ উদ্দিন, রেহাজ উদ্দিন প্রমুখ। মানিকগঞ্জ শহরের ছিলেন-ডা.শামসুর রহমান, সৈয়দ আনোয়ার আলী চৌধুরী, ওয়ারেশ উদ্দিন পাশা, জাফর আলম চৌধুরী, খন্দকার দেলোয়ার হোসেন প্রমুখ।” তিনি আরো বলেন, “আন্দোলনের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং পুলিশ হুলিয়া জারি করে এর মধ্যে চারজনকে গ্রেফতার করে। আমরা আত্মগোপনে থেকে আন্দোলনের কাজ চালিয়ে যাই।”
একই বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র ভাষা সংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধা মিরান উদ্দিন মাস্টার বলেন, “আমাদের নেতা প্রয়াত প্রমথনাথ নন্দীর দিকনির্দেশনায় আমি হ্যান্ডবিল বিলি করি। ছাত্রদেরকে সংগঠিত করি এবং মিছিল নিয়ে মানিকগঞ্জ অভিমূখে রওনা হই। কিন্তু, পুলিশ আমাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তখন কাউকে গ্রেফতার করেনি। তবে পরবর্তীতে মামলা করে হুলিয়া জারি করে এবং রেহাজ উদ্দিন, ওয়াজ উদ্দিন, ওয়ারেশ পাশা ও জাফর আলমকে গ্রেফতার করে। হুলিয়া জারির পর কয়েক জন ঢাকায় যায় এবং সেখানে আন্দোলনের সাথে যোগ দেন। গ্রেফতারের পর আন্দোলনের তীব্রতা আরো বৃদ্ধি পায়। তারই ফলশ্রুতিতে আমরা পাই রাষ্ট্র ভাষা বাংলা। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে তৎকালীন সরকারের আমলে বাংলা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি পায়।”
বীর মুক্তিযোদ্ধা এ্যাড.আজাহারুল ইসলাম আরজু বলেন, “আমরা ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামী উত্তরসূরীদের উদ্দীপনা ও চেতনায় ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ও ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি। আজকে নতুন প্রজন্মকেই দায়িত্ব নিতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এই দেশ পরিচালনার।” অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির জেলা সভাপতি এ্যাড. দীপক কুমার ঘোষ। তিনি বাংলা-ইংরেজি ও উর্দু ভাষা দিয়ে কয়েকটি বাক্য বলেন এবং নতুন প্রজন্মকে কোন ভাষাটি ভালো লাগে সেটি বলতে বলেন। নতুন প্রজন্ম করতালির মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে ভালো লাগার কথা বলেন। তিনি নতুন প্রজন্মকে মায়ের ভাষা লালন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার আহবান জানান।