ফসলের লাভজনক মুল্য পাচ্ছেন নয়াবাড়ি আদর্শ গ্রামের কৃষাণিরা
সিংগাইর, মানিকগঞ্জ থেকে শিমুল বিশ্বাস
সিংগাইর উপজেলার নয়াবাড়ি আদর্শগ্রামের কৃষানিদের বাড়িতে উৎপাদিত হচ্ছে নানা ধরনের জৈব শাকসবজি। বিগত দিনে এসব সবজি তারা বায়রা বাজারে বিক্রি করতো। তবে পণ্য বিক্রির অধিকাংশ টাকা নারীদের হাতে না আসায় মনে অসন্তোষ প্রকাশ করতেন এ গ্রামের নারীরা। সম্প্রতি উক্ত গ্রামের ১৫ জন নারী ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের পণ্যগুলো রাজধানী শহর ঢাকায় বিক্রি করা শুরু করেছেন। প্রতি সপ্তাহে গড়ে সাত থেকে আট হাজার টাকার পণ্য ঢাকাতে পাঠানো হয় বলে তারা উল্লেখ করেছেন। তাদের রেজিষ্ট্রার খাতার হিসাবে দেখা যায় যে, গত ৬ মাসে ১,৫২,০০০ (একলাখ বায়ান্ন হাজার) টাকার জৈব পণ্য সরাসরি ঢাকার বাজারে বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন উক্ত সংগঠনের ১৫ জন নারী।
নয়াবাড়ি আদর্শগ্রাম কৃষক কৃষাণি সংগঠনের সভাপতি কমলা বেগমের নেতৃত্ব, সহযোগিতা ও উৎসাহে বাড়ির আঙিনায় ও পালানী জমিতে চাষ করা সবজি ও নিজ বাড়িতে স্বাভাবিকভাবে পালন করা মুরগি ও ডিম এবং বাড়ির আশেপাশের আপনজ¦ালা শাক, লতাপাতা কোন ধরনের মধ্য স্বত্বভোগির হস্তক্ষেপ ছাড়াই প্রতি সপ্তাহে রাজধানী শহর ঢাকাতে বিক্রি করছেন এ উদ্যোগী নারীগণ। পণ্য বিক্রির অর্থ মোবাইল বিকাশ একাউন্টের মাধ্যমে বিক্রেতাদের কাছে সরাসরি পাঠিয়ে দিচ্ছেন পণ্য ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ঢাকাস্থ “প্রাকৃতিক কৃষি বিপনন কেন্দ্র”। যার ফলে বিক্রিত অর্থের টাকা নিজের মতো করে ব্যয় করার ক্ষেত্রে কোন ধরনের বাধা নেই বলে এসব নারীগণ মনে করছেন।
২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে বারসিক এর সহায়তায় নয়াবাড়ি কৃষক কৃষাণি সংগঠনের সাথে প্রাকৃতিক কৃষি বিপনন কেন্দ্রের সমন্বয় হয়। উক্ত বিপনন কেন্দ্রের সাথে বিক্রয় সম্পর্ক স্থাপনের জন্য বারসিক এর সহায়তায় ঢাকার প্রাকৃতিক কৃষি বিপনন কেন্দ্র ভিজিট করেন সংগঠনের সদস্যগণ। অন্যদিকে প্রাকৃতিক কৃষি বিপনন কেন্দ্রের প্রতিনিধিগণ নয়াবাড়ি গ্রামে এসে সংগঠনের সদস্যদের সাথে মতবিনময় সভা করেন। সিদ্ধান্ত হয় সভাপতি কমলা বেগম সকল সদস্যর নিকট থেকে পন্য সংগ্রহ করে প্রতি সপ্তাহে একবার ঢাকাতে পাঠাবেন। পণ্য পাঠানোর যাবতীয় খরচ বহন করবেন প্রাকৃতিক কৃষি। আর পণ্যের দাম নিধারণ করবেন স্ব স্ব পণ্য উৎপাদনকারীগণ। বিক্রির যাবতীয় টাকা বিকাশ একাউন্টের মাধ্যমে বিক্রেতার নিকট পাঠানো হবে। গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নয়বাড়ি আদর্শগ্রাম কৃষক কৃষাণি সংগঠনের ১৫ জন নারী প্রাকৃতিক কৃষি বিপনন কেন্দ্রে নিয়মিত পণ্য পাঠানো শুরু করেন।
প্রতি সপ্তাহের নির্ধারিত দিনে প্রত্যেক সদস্য তাদের পণ্যগুলো নিজ দায়িত্বে নিয়ে আসেন কমলা বেগমের বাড়ি। সকলে মিলে পণ্যের দাম নির্ধারণ করেন। কমলা বেগম মালামালগুলো নিজস্ব পদ্ধতিতে প্যাকেট করেন। চুক্তি করা সিএনজি গাড়ির মাধ্যমে পাঠানো হয় ঢাকাতে। প্রত্যেক সদস্যের পণ্যের মূল্য প্রদানের জন্য কমলা বেগম তৈরি করেছেন রেজিষ্ট্রার খাতা। উক্ত খাতা দেখে সদস্যর পণ্যের মুল্য প্রদান করেন তিনি।
প্রাথমিকভাবে বারসিক এর পক্ষ থেকে পণ্য পাঠানো এবং বিক্রিত অর্থ প্রাপ্তি সহায়তা করা হলেও বর্তমানে উক্ত কার্যক্রম সংগঠনের সভাপতি নিজেই নিয়ন্ত্রণ করছেন। এ প্রসংগে সংগঠনের সভাপতি কমলা বেগম বলেন, “বর্তমানে বিষমুক্ত খাবারের চাহিদা বাড়ছে। তয় আমাগো এলাকার বাজারে চাহিদা বেশি না। তাই আমরা সগলে (সকলে) মিলে লাউ, কুমড়া, চিচিংগা, কলা, বেগুন, ঢেড়শ, পেঁপে, কাকরোল, ধুন্দল, ঝিংগা, পুইশাক, লালশাক, ধনিয়াপাতা, মেথিশাক, কলমি শাক, ঢেকিশাক,কলার মোচা, কচুর লতি, থানকুনি পাতা শাক, সীম, বরবটি, দেশী মুরগি, দেশী ডিম, গাব, জাম্বুরা, শাপলা, আলু এক জায়গা করে ঢাকায় পাঠাই। এতে করে আমাগো গ্রামের বাজারের থেইক্যা বেশি দাম পাই।”
অন্যদিকে কৃষাণি জয়তুন বেগম বলেন “অহন (এখন) আমরা ট্যাকা নিজেগো হাতে পাই। তাই আমাগো ইচ্ছে মতো খরচ করবার পারি। আগে তো পুরুষ পোলাগো (পুরুষ ছেলে) কাছে বাজারে বিক্রি করবার দিতাম। কোন্ সুময় ট্যাকা দিতো আবার কোন্ সুময় দিতো না।” কৃষাণি রাহেলা বেগম বলেন, “ট্যাকাগুলান হাতে পাউনে আমরা পোলা মাইয়াগো আবদার মিটাবার পারি”।
নয়াবাড়ি আদর্শ গ্রামের জৈব পণ্য সরবরাহকারী এ দল সম্পর্কে প্রাকৃতিক কৃষি বিপনন কেন্দ্রের পরিচালক দেলোয়ার হোসেন বলেন, “নয়াবাড়ি আদর্শগ্রামের এ দলটির কাজের মধ্যে সচ্ছতা ও দায়িত্ব বোধ আছে। তারা নিয়মিত আমাদের সাথে যোগাযোগ করার মধ্য দিয়ে বিক্রয় সম্পর্ক ধরে রেখেছেন। তাই দেশের মানুষকে নিরাপদ খাদ্য সরবরাহের জন্য নয়াবাড়ি দলের মতো আরো উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসা জরুরি”।