জলবায়ু পরিবর্তন ও উপকূলীয় অঞ্চলে গ্রামীণ নারীর টিকে থাকার সংগ্রাম
সাতক্ষীরা থেকে মফিজুর রহমান
বাংলাদেশের মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হলো উপকূলীয় অঞ্চল। সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় সাতক্ষীরা জেলার সুন্দরবন সংলগ্ন শ্যামনগর উপজেলা বিশ্বে পরিচিত। প্রাকৃতিক দুর্যোগ-বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, নদী ভাঙন এ উপজেলার নিত্যসঙ্গী। এছাড়াও উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে লবণ পানির দুর্যোগ প্রতিনিয়ত ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে চলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশের দক্ষিণ উপকূলজুড়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বাড়ছে তেমনি বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় নিচে নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। কৃষি জমিতেও লবণাক্ত পানির আগ্রাসন বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটির পর একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপকূলে আঘাত হানছে। নদীভাঙনের ফলে প্রতিবছর চাষযোগ্য জমি কমে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রত্যক্ষ প্রভাবটি পড়ছে কৃষির উপর। যে কারণে দুর্যোগের ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি ও কৃষক। আর এভাবেই চরম হুমকির মুখে দিনাতিপাত করছে উপকূলের মানুষ। এসকল প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে মোকাবেলা করে উপকূলীয় অঞ্চলের গ্রামীণ নারীরা টিকে থাকার নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।
উপকূলীয় শ্যামনগরের পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পাখিমারা গ্রামের মাফিজা ও আমবিয়া বেগম বলেন,“লবণ পানির চিংড়ী ঘেরের ফলে কৃষি জমি না থাকায় শুধুমাত্র বসতভিটায় সারাবছর সবজি চাষ করি। পুকুর কেটে বৃষ্টির পানি ধরে রাখি এবং নিদিষ্ট স্থানে মাটি উঁচু করে সবজি চাষ করি।” তিনি আরও বলেন, “বর্ষা মৌসুমে ঢেড়ষ, ধুন্দুল, পুঁইশাক, সীম, লাউ, লালশাক, পালংশাক, কচুরমূখী, কুমড়া, চালকুমড়াসহ ১০ রকম সবজি চাষ করেছি। বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়ার সাথে সাথে শীত মৌসুমের জন্য সবজি লাগানো শুরু করি। কারণ মাটির জোঁ চলে গেলে আর ফসল লাগানো সম্ভব হয় না”।
বুড়িগোয়ালিনী আশ্রায়ন প্রকল্পের (ব্যারাক) কৌশল্যা মুন্ডা ও রুহিত দাস তাদের দীর্ঘদিনের কৃষি সংগ্রামের চিত্র তুলে ধরে বলেন, “দক্ষ ও অভিজ্ঞ কৃষক প্রতিনিধি দল ব্যারাকের মাটি ও পানি মুখে দিয়ে পরীক্ষা করেন এবং ব্যারাকের প্রতিটি পরিবারের প্লটের মাটির কৃষি উপযোগী করার জন্য ৩/৪ ঝুুড়ি গোবর দিয়ে মাটি প্রস্তুত, পুকুরের পানি কৃষি কাজে সেচ দেওয়ার জন্য ফিল্টার মেরামত, গবাদিপশুর প্রতিরোধে ব্যারাকের বেড়া/ঘেরা দেওয়ার সুপারিশ করেন।” তিনি আরও বলেন, “তাদের পরামর্শে বারসিক সুপারিশকৃত সমস্যা সমাধানে সহযোগিতা করে। এরপর কৃষকেরা তাদের সংরক্ষিত ঢেড়ষ, বরবটি, মিষ্টি কুমড়া, ঝিঙ্গা, পুঁইশাক, পেঁপে ও ডেমোশাক, শসার বীজ বিতরণ করেন।” কৃষক সিরাজুল ইসলাম,নিরাঞ্জন জোয়ারদার ও ফরিদা পারভীন বলেন, “ব্যারাকের মাটি কিছুটা লবণাক্ত হলেও কৃষি কাজের উপযোগী করা যাবে। ১/২ টা বছর মাটিতে জৈব সার ও নিয়মিত সেচ এবং বর্ষার পানি পেলে এখানে প্রচুর সবজি বছরব্যাপী চাষ করা সম্ভব।” ব্যারাকের প্রথম পর্যায়ে মাটির লবণাক্ততায় সবজি বীজে চারা হয়নি। কিন্তু ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় বর্তমানে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী তাদের বসতভিটা সংলগ্ন কৃষি জমিতে পুঁইশাক, লাউ, ঝিঙ্গা, মিষ্টি কুমড়া, শসা, পালংশাক, কচুর মূকি, ঢেড়ষ, চালকুমড়া, সীম, উচ্ছে, বরবটি উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে। ব্যারাক জনগোষ্ঠী জানান, বর্তমানে তাদের মাটিতে ফসল হচ্ছে। বর্ষার সকল বীজে চারা বের হয়েছে। তারা সকলে এখন সবজি উৎপাদন করে খেতে পারছেন। কিছু বিক্রি করে সংসারের চাল, তেল, নুন, ঝাল কিনতে পারছেন।”
গাবুরা ইউনিয়নের চকবারা গ্রামের বাঘবিধবা ছকিনা বেগম বলেন, “আইলার পর বসতভিটায় পুকুর কেটে মাটি ভরাট করে একটি নির্দিষ্ট স্থানে মাটি উঁচু করে সবজি চাষ শুরু করি। আমি বর্ষমৌসুমে ঢেষড়, ধুন্দুল, পুঁইশাক, সীম, লাউ, লালশাক, পালংশাক, কচুরমূখী, কুমড়া, চালকুমড়াসহ ১০ রকম সবজি চাষ করেছি”। বুড়িগোয়ালিনী ব্যারাকের সফল সবজি চাষী (লবণাক্ত মাটিকে কৃষি উপযোগী করতে সক্ষম) রুহিত দাস, ছকিনা বেগমের সবজি ক্ষেত দেখে বলেন, “তিনি সবজি চাষে মাটি উঁচু করে ঠিক করেছেন। গাবুরার মাটি নোনা বেশি। সেজন্য এখানে সবজি চাষের জায়গাটা একটি উঁচু হলে ভালো হয়। অনেক রকম সবজি তিনি চাষ করে সফল হয়েছেন। গ্রামের এ ধরনের কাজের নারীদেরকে মাচা তৈরি করে দিলে তারা অনেক লাভবান হবে। সেখান থেকে অনেককে সবজির বীজ দিতে পারবে, যেভাবে আমরা ব্যারাকে বীজ বিনিময় করি। নিজের পরিবারের চাহিদা পূরণে আমাদের মত সফল হবে”।
ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে কৃষিজমির পরিমাণ জনসংখ্যার তুলনায় কম। সে জমির উল্লেখযোগ্য অংশ লবণাক্ততার শিকার হওয়ায় কৃষির জন্য বিপর্যের হাতছানি দেখা দিচ্ছে। এসমস্যা মোকাবেলায় দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। কীভাবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে লবণাক্ততার হাত থেকে রক্ষা করা যায় সে পথ খুজে বের করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে সৃষ্ট সিডর, আইলা, লবণাক্ততা, খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের উপকূলীয় দক্ষিণ-পশ্চিাঞ্চলের স্থানীয় কৃষি প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর জীবনযাত্রা পুনঃগঠনে স্থানীয় জনগণের উন্নয়ন পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নে সহযোগিতা করা জরুরি। লবণাক্ত মাটি-পানি-পরিবেশ-প্রতিবেশে যে সকল প্রাণসম্পদ টিকে থাকার সক্ষমতা রয়েছে সে ধরনের সহযোগিতা স্থানীয়দের বেঁচে থাকার জন্য ভীষণ জরুরি। পাশাপাশি নোনা মাটি ব্যবস্থাপনায় সুপেয় পানির সেচ ব্যবস্থাপনা ও জৈব ব্যবস্থাপনা সহযোগিতা লবণাক্ত দুর্যোগ মোকাবেলায় করে স্থানীয় মানুষের বেঁচে থাকার শক্তি-সাহস ও সংগ্রামকে আরো বেশি শক্তিশালী ও উদ্যোগী করে তুলবে।