ঔষধি উদ্ভিদ ব্যবহারকারী-পারুল আক্তার
নেত্রকোনা থেকে পার্বতী রাণী সিংহ:
সেই প্রাচীনকাল থেকে ইতিহাসকে স্বাক্ষী রেখে নারী কৃষি সভ্যতার সূচনা করেছিল। প্রকৃতির সাথে মিথষ্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে সভ্যতা। প্রকৃতিকে ধারণ করেই জীবনযাপন শুরু হয়েছিল। প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণের গতি, প্রকৃতি ও র্ধম থেকে জ্ঞান আহরণ করা হত। প্রকৃতিতে যা পাওয়া যেত তা দিয়েই মানুষ তাদের খাদ্য, কৃষি ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার চাহিদা পূরণ করতো। মোট কথা, জীবনধারণে জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় সব ধরনের উপকরণই মানুষ প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করতো।
কিন্তুু আধুনিকতার গতিশীলতার গতিময়তায় প্রকৃতি থেকে ক্রমে ক্রমে মানুষ দূরে সরে যাচ্ছি। প্রকৃতি থেকে যে সংস্কৃতির উদ্ভব হয়েছিল আজ তা বিপন্ন। মানুষ এখন তাদের সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করতে চায়। এই দ্রুততার সুযোগ নিয়ে গড়ে ওঠেছে ঔষধ কোম্পানি, হাজার হাজার রোগী দেখার চেম্বার ও পরীক্ষা নিরিক্ষার যন্ত্র। কিন্তুু মানুষ কখনোই তাদের চারপাশের পড়ে থাকা, অনাদরে জন্মানো একটি ঔষধি গাছের কথা মনে রাখে না। এই অবহেলা দেখে বিখ্যাত লেখকের সেই কবিতাটি মনে পড়ে যায়,
দেখিতে গিয়েছি র্পবতমালা, দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু,
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া,ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া,
একটি ধানের শিষের উপর একটি শিশির বিন্দু।
কিন্তুু আশার কথা হল আমাদের গ্রামীণ সমাজে এই অচাষকৃত ঔষধি উদ্ভিদের ব্যবহারগুলো সীমিত পরিসরে হলেও এখনও চলমান রয়েছে।
নেত্রকোনা জেলার চল্লিশা ইউনিয়নের সনুরা গ্রামের নারী পারুল আক্তারের (৩২) কথাই ধরা যাক। তিনি প্রকৃতিতে থাকা ঔষধি ব্যবহারকারী। কৃষক পরিবারে জন্ম তার। সেই সুবাদে দাদী,নানী ও মায়ের কাছ থেকে তিনি গাছ চেনা শুরু করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি তার পরিবারকে নানান জাতের গাছ-গাছালি দিয়ে ঔষধ তৈরি করতে এবং ব্যবহার করতে দেখেছেন। নিজের কৌতুহল বসেই গাছ-গাছালির সাথে পরিচয় হয় তাঁর। বাড়ির চারপাশে পরিবেশসম্মত রুচিশীলভাবে সাজিয়ে তোলেন কৃষাণী পারুল আক্তার। তাঁর স্বামী নুরুল ইসলাম একজন কৃষক। এক মেয়ে ও তিন ছেলেসহ ছয় জনের সংসার তাঁর। সংসারের কাজের পাশাপাশি স্বামীকে কৃষি কাজে সহায়তা করেন। সনুরা গ্রামে বধু হয়ে আসেন প্রায় ১৮ বছর আগে। বিয়ের পর নিজের সংসারের অভাব দূর করতে তিনি নিজের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে বাড়ির চারপাশে শাকসবজি চাষ শুরু করেন। তিনি হাসঁ মুরগী গরু ছাগল পালন শুরু করেন। এভাবেই সবজি, হাঁস-মুরগি, নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটায় সারাদিন। সারাবছর ধরেই বৈচিত্রময় শস্য, শাকসবজি চাষ করেন। যখন জমিতে কোন কিছু থাকে না তখন পেপেঁ চারা, পেপেঁ, হাঁেসর বাচ্চা তুলে বিক্রি করে হাল ধরেছেন সংসারের।
গ্রামীণ জীবনযাপনে প্রকৃতির সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা বা সখ্যতা আরো নিবিড় হয়েছে বাড়ির আশপাশে থাকা ঔষধি উদ্ভিদ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। পেটের পীড়া থেকে নিজেকে এবং পরিবারের সকলকে প্রতিষেধক হিসাবে ব্যবহার করেন বাড়ির আশপাশে থাকা থানকুনি পাতা। থানকুনি পাতার রস করে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে খান। তিনি কৃমিনাশক হিসাবে ব্যবহার করে সুপারি গাছের পুরাতন শেকড়, আনারসের কচি ডগা, জাম গাছের বাকল ব্যবহার করেন। পারুল আক্তার বাকল, শেকড়গুলো রাতে ভিজিয়ে রেখে সকালে শেকড় ছেঁচে রস করে খালি পেটে গ্রহণ করেন। অন্যদিকে হাসঁ-মুরগির পা মচকে গেলে অর্জুন গাছের বাকলের সাথে হলুদ মিশিয়ে ব্যবহার করেন। বর্ষাকালীন সময়ে নারী, শিশুদের হাতে পায়ে ঘাঁ হয়। তিনি ঘাঁ উপশমে রাতের কাজ শেষ করার পর হাত-পা ভালোভাবে শুকিয়ে সরিষার তেল ব্যবহার করেন। মেয়েলি রোগে এবং বাচ্চা প্রসববের পর মায়েদের ক্ষেত্রে লজ্জাবতীর পাতা, মূল সম্পূর্ণ উদ্ভিদ ব্যবহার কওে নিরাময় করেন।
ঈারুল আক্তার চুলকানি বা খোসপাচড়াতে-হলুদ এবং নিম পাতা ব্যবহার করেন। কাচাঁ হলুদ ও নিম পাতা বেঁটে গায়ে মেখে ব্যবহার করেন। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে এটি ব্যবহার করেন। শরীরের বিষ ব্যাথাতে দলকলম পাতা ব্যবহার করেন। এর পাতা সরিষার তেল দিয়ে ভেজে খাবার হিসাবে গ্রহণ করেন। কোমড় ব্যথায় গোবর ও চুটরা পাতা ব্যবহার করেন। তিনি পরিমাণমত গোবর ও চুটরা পাতা একসাথে পাতিলে নিয়ে গরম করেন। তারপর মাটিতে ছোট গর্ত করে এগুলো রাখেন। গর্তের উপর একটি ছোট বিছানা করেন। যাতে শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে তাপ লাগে। তারপর গর্তের উপর শুয়ে ছ্যাক নেন। হঠাৎ পেট ব্যথা হলে কাঁটা খূড়ে গাছের মূল ব্যবহার করেন। মূল ছেচেঁ রস করে ব্যবহার করেন। বড় অথবা ছোটদের বেলায় আমাশয় হলে র্অজূন গাছের বাকল ব্যবহার করেন। বাকল ছেঁচে রস করে ব্যবহার করেন।
এই প্রসঙ্গে পারুল আক্তার বলেন, ‘আমি এবং আমার পরিবারের সবাই সব সময় থানকুনি পাতা, হলুদ ব্যবহার করি। এখন তো আর বাইরে কেউ যায় না। কোন সময় অসুখ বিষুখ হলে গাছ-গাছালিই আমি বেশি ব্যবহার করি। আশপাশের সবাই আমার কাছে জানতে আসে। আমাদের অসুখ বিসুখ কম হয়।’ পারুল আক্তার শুধুমাত্র তার এই জ্ঞান নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। গ্রামের অনেক নারী আসে পরার্মশ নিতে। তিনি তাদেরকে গাছগুলো চিনিয়ে দেন এবং ব্যবহার পদ্ধতিগুলো বুঝিয়ে দেন। তিনি তাদেরকে প্রতিষেধক হিসাবে সবসময় ঔষধি গাছ ব্যবহারের পরার্মশ দিয়ে থাকেন।
প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত উপাদান ব্যবহারকারীদের জ্ঞান ও চর্চা সংকট মোকাবেলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে, যা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে। আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে গ্রামীণ নারীদের জ্ঞান ও চর্চাকে স্বীকৃতি জানাতে।