নিজেদের দায়িত্ব বুঝে নিলেন বড়মুল্লূক স্পোর্টিং ক্লাবের তরুণরা

রাজশাহী থেকে মো. জাহিদ আলী, এনামুল হক এবং রবিউল হক

 

বড়মুল্লুক গ্রামের তরুণ দল

 

নওগাঁর মান্দা উপজেলার আত্রাই নদের দক্ষিণ দিকে এবং বহুল আলোচিত ঐতিহাসিক হিরা নদীর পাড় দিয়ে রাস্তার পার্শ্বে অবস্থিত ১১নং কালিকাপুর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডে বড় মুল্লুক গ্রামটি অবস্থিত। গ্রামটিতে বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৫০০ জন। ঐতিহাসিকভাবেই গ্রামটি নানা ঐতিহ্যে ভরপুর। বড়মুল্লুক গ্রামে অতি প্রাচীনকালের একটি মন্দির আছে, একটি বড় পুকুর আছে, সাথে একটি প্রাচীন আমলের শতবছরী বটবৃক্ষ আজো দন্ডায়মান । প্রাচীন আমলের সাক্ষী হিসেবে এখানে একটি গোবিন্দ মন্দির আছে, পৌষ মাসে এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে নানা অঞ্চল থেকে মানুষ আসে মহাপ্রভুর ভোগ নিতে। গ্রামটির মাটির গুনাগুণ বরেন্দ্র অঞ্চলের কর্দমাক্ত লাল মাটির থেকে একটু ভিন্ন, বেশির ভাগ মাটি বেলে দোআঁশ মাটি হওয়ায় এখানে সব ধরনের ফসল ভালো ফলে। নানা বৈচিত্র্যে ভরপুর বড়মুল্লুক গ্রামটির ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, খেলাধুলা এবং নিজেদের গ্রামকে উন্নত করতে ওই গ্রামের কিছু আগ্রহী তরুণ ‘বড়মুল্লুক ডায়মন্ড ক্লাব’ গঠন করে। গ্রামের নানাবিধ সমস্যা নিরসন এবং গ্রামকে উন্নত করার ব্রত নিয়ে এগিয়ে চলে তাদের কার্যক্রম। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে তারা নানা কর্মসূচিতে জড়িত হয়েছেন। অংশ নিয়েছেন প্রশিক্ষণ, কর্মশালা, তথ্যমেলাসহ নানাবিধ কার্যক্রমে। বিকশিত করে চলেছেন তাদের সামনের দিকে এগিয়ে চলা।

 

কার্যকর অংশগ্রহণ

নওগাঁর মান্দার কালিকাপুর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের মেম্বার ডা. বিষ্ণু বাবু। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হওয়ার পাশাপাশি তিনি একজন গ্রাম্য পল্লী চিকিৎসক। বড়মুল্লুক ডায়মন্ড ক্লাবকে তিনিই বারসিক সম্পর্কে অবগত করেন এবং বারসিক’র কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করেন। পরবর্তীতে বারসিক’র সাথে যোগাযোগ করে তারা ওয়ার্ড ওয়াচ গ্রুপের সদস্য হন। ডায়মন্ড ক্লাবের মোট সদস্য এখন ২৫ জন এর ভেতর ৪ জনই ওয়ার্ড ওয়াচ গ্রুপের সদস্য। তারা মানবাধিকার ও সুশাসন এবং জেন্ডার বিষয়ক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। প্রশিক্ষণ পরবর্তী সময়ে তারা নিজেদের ভেতর নারী-পুরুষের সমতা, নেতৃত্ব, মানবাধিকার ও সুশাসন নিয়ে আলোচনা করেন। পরবর্তীতে ইউনিয়ন পরিষদের সাথে দেখা করেন এবং ইউনিয়ন পরিষদের সেবা ও সহযোগিতা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন। নিজেরা মিলে গ্রামের অতিদরিদ্র পরিবারের প্রবীণ, বিধবা, দুঃস্থ নারীদের তালিকা তৈরি করেন এবং তাদের সেবা দেয়ার জন্য বারবার ইউনিয়ন পরিষদের সাথে দেখা করেন। তাদের তালিকা ও প্রস্তাবের ভিত্তিতে ইউনিয়ন পরিষদ তাদের তালিকা থেকে গ্রামের ২ জন নারীকে বিধবা ভাতা, ২ জনকে বয়স্ক ভাতা এবং গ্রামের জন্য ৩টি নলকূপ বরাদ্দ করে। এ কাজের সাথে যুক্ত হয়ে তারা ইউনিয়ন পরিষদের বাজেট সম্পর্কে জানতে পারেন এবং গ্রামের তরুণদের জন্য ক্রীড়া ও বিনোদন বিষয়ে বাজেট রাখার দাবি উত্থাপন করেন।

 

হার না মানা তারুণ্য

২০০৭ সালে ডায়মন্ড ক্লাবটি তৈরি হলেও কিছুদিন বিভিন্ন খেলাধুলা এবং নানাধরনের কার্যক্রম পরিচালনার পর ধীরে ধীরে কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। বয়সে বড়রা ক্লাবটির হাল ছেড়ে দিলেও থেমে থাকেনি গ্রামটির বর্তমান তরুণ প্রজন্ম। লেখাপড়া, কৃষি কাজ এবং বিভিন্ন কাজের পাশাপাশি তরুণরা ক্লাবটিকে নতুন উদ্যোগে পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এরই উপলক্ষে তরুণরা সংঘবদ্ধ হয়ে ২০১৩ সালে শেষের দিক থেকে ক্লাবটির মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে নানা ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ করে আসছেন। বর্তমান প্রজন্মের নানা পেশার ২৫জন তরুণ বর্তমান গ্রামটির বাল্য বিবাহ রোধে অবিভাবকদের পরামর্শ, বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা এবং ইভটিজিং প্রতিরোধসহ ইউনিয়ন সেবা পরিসেবাসমুহ বিষয়ে কাজ করেন। নিজেদের ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতির প্রসারে প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবসে গ্রামীণ খেলাধুলার আয়োজন করেন। এ ছাড়াও গ্রামের ছোট খাটো বিপদে গ্রামের লোকদের পাশে এসে তরুণরা সহযোগিতা করেন। নিজেদের গ্রামের পরিবেশ রক্ষায় দেশীয় প্রজাতির বৃক্ষরোপণ এবং আগামীতে পরিত্যক্ত জমি এবং রাস্তার দুইধারে বৃক্ষরোপণের পরিকল্পনার উদ্যোগ হাতে নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে স্থানীয় কলেজে ডিগ্রী প্রথম বর্ষে পড়–য়া ছাত্র ও সংগঠনটির সদস্য মো. নাজমুল হক (২১) বলেন, “আমাদের সিনিয়রা কøাবটি শুরু করেছিলো, কিন্তু দিনে দিনে ক্লাবটির সকল কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়, আমরা ভাবলাম এটি আবার চালু করা দরকার, তাই সবাই সংগঠটি নতুনভাবে চালু করি।” তিনি আরো বলেন, “আমরা একটা কাজ করছি, তা হলো গ্রামটিতে যে কোন ধরনের শিশু স্কুল থেকে যেন ড্রপআউট না হয় এবং সবাই স্কুলে যায় সে বিষয়ে আমরা পরিবার পরিবার ঘুরে জানার চেষ্টা করছি এবং পরামর্শ দিচ্ছি নিয়মিত স্কুলে যবার জন্যে একই সাথে আমরা পরিবারের কি ধরনের সমস্যার কারণে শিক্ষার্থীরা বা সন্তানরা স্কুলে যায় যেতে পারে না সেটিও বোঝার চেষ্টা করছি।” অন্যদিকে সদস্য নাজমুল বলেন, “আমাদেরকে সংগঠনটি শক্তিশালী করতে যে সহযোগিতাগুলো দরকার তা দিলে আমরা অনেক দূর এগুতে পারবো।” ছোট মুল্লুক গ্রামের হাসান আলীর মেয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ুয়া মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছিল ২০১৫ সনে। তারা বাধা দিয়েছিলেন, কিন্তু পারেনি। বুঝতে পেরেছেন বাল্যবিবাহ বন্ধে শুধুমাত্র আইনের কঠোরতা দিয়ে হবে না, এর জন্য পারিবারিক পর্যায় থেকে সামাজিকভাবে সচেতনতা তৈরি হতে হবে। নারীদের প্রতি ইতিবাচক মূল্যবোধ জাগ্রত হতে হবে। আর এটি জাগাতে ক্লাবটি আরো বেশি নতুন প্রজন্মকে যুক্ত করে একসাথে কাজ করবার স্বপ্ন দেখছে। নিজেদের দায়িত্ব বুঝে নিলেন বড়মুল্লূক স্পোর্টিং ক্লাবের তরুণরা।

 

happy wheels 2