হাওরাঞ্চলের কৃষকরা হাওরে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করতে চায়
হাওর থেকে সুয়েল রানা
এখন ফাল্গুন মাস। এ মাসটি হাওরাঞ্চলের কৃষকদের অনেক ব্যস্ততায় কাটে হাওরের একমাত্র ফসল বোরো ধানের ক্ষেত পরিচর্যায়। হাওরাঞ্চলে বছরের প্রায় ৬/৭ মাস পানিতে নিমজ্জিত থাকায় কৃষকরা এসময় মাঠে কোন ফসল ফলাতে পারেনা। অগ্রহায়ণ মাসের দিকে হাওরের পানি নামতে শুরু করলে কৃষকরা বোরো ধানের বীজতলা তৈরির কাজ ব্যস্ত হয় এবং পৌষ মাসে বীজতলায় ধানের বীজ বপন করে। মাঘ মাসে হাওরের জমিতে বোরো ধানের চারা রোপণ করে। জমি প্রস্তুতি ও ধানের চারা রোপণের জন্য হাওরাঞ্চলের কৃষকদের জিরানোর (বিশ্রাম) কোন ফুসরত থাকেনা। ধান রোপণের পর তারা ব্যস্ত হয় ধানের চারার পরিচর্যা, জমিতে সেচ দেয়া ও আগাছা নিড়াতে। আগাছা নিড়ানোর পর ধানের চারাগুলো বড় হলে জমিতে মাঝে মাঝে সেচ দেয়া ছাড়া তেমন কোন কাজ থাকেনা কৃষকদের হাতে। তখন তাদের হাতে অফুরন্ত সময় থাকে। এসময় থেকে তারা ধান পাকার অপেক্ষায় থাকে। তবে যেসকল কৃষকদের বসতভিটার উঁচু জমি বা অপেক্ষাকৃত উঁচু জমি রয়েছে তারা সেসব জমিতে রবি ও খরিপ মৌসুমে সামান্য পরিমাণে বৈচিত্র্যময় সবজি ও শস্য ফসল (মরিচ, বাদাম, ভূট্টা, গম, সরিষা, মাসকলাই ইত্যাদি) চাষ করেন। তবে এসব ফসল চাষ করতে বীজ ও সারসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণের জন্য কৃষকরা বাজারের উপর নির্ভরশীল। বীজ, সার ও কীটনাশক ক্রয় করে চাষাবাদ করায় উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যায়, ফলশ্রুতিতে লাভ হয় সামান্য। ফলে অনেক কৃষক ধারাবাহিকভাবে সবজি ও অন্যান্য শস্য ফসল চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
বারসিক ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে মদন উপজেলার হাওরাঞ্চলে (মদন সদর ও গোবিন্দশ্রী ইউনিয়ন) কার্যক্রম আরম্ভ করে। বারসিক শুরুতে দু’টি ইউনিয়ন পরিদর্শন করে এবং কৃষকদের সাথে উঠান বৈঠক করে ধান ফসল চাষ, কাটা ও মাড়াইসহ মোট উৎপাদন খরচ এবং উৎপাদিত ধান বিক্রির আয়ের হিসাব তুলনা করে দেখে যে, ধান চাষ করে কৃষকদের তেমন আয় থাকেনা। কিন্তু কোন উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে তারা ধান চাষ করে বছরের খোরাক ঘরে তোলার জন্য। তবে ধাপে ধাপে (কিস্তিতে) অল্প অল্প খরচ খরচ করে ধান বিক্রি করে এক সাথে অনেকগুলো টাকা পাওয়ায় কৃষকরা অনেকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারে। যেসব কৃষকদের বসতভিটা ছাড়াও উঁচু জমি রয়েছে এবং যেসব জমিতে ধান ছাড়াও অন্যান্য ফসল চাষ করা যায়, বারসিক তাদেরকে সেসব জমিতে শুধুমাত্র ধান চাষ না করে ধানের বিকল্প হিসাবে অন্যান্য ফসল চাষ করার পরামর্শ প্রদান করে। এতে আগাম বন্যার মত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবল থেকে ফসল রক্ষা পাবে এবং কৃষকরাও ক্ষতির হাত থেকে রেহাই পাবে। বারসিক হাওরে জমি লিজ নিয়ে কৃষকদের অংশগ্রহণে এলাকা উপযোগি শস্য ফসলের জাত নির্বাচনে বৈচিত্র্যময় শস্য ফসলের প্রায়োগিক গবেষণা পরিচালনা করে আসছে। গবেষণা প্লট থেকে কৃষকরা তাদের পছন্দের বেশকিছু শস্য ফসলের জাত নির্বাচন করে, যেমন- ভূট্টা, গম, সরিষা, মটরশুটি ইত্যাদি। হাওরে শুষ্ক মৌসুমে পরিবেশবান্ধব/ জৈব উপায়ে নিরাপদ সবজি ও শস্য ফসল উৎপাদনে বারসিক কৃষকদর উদ্বুদ্ধ করে আসছে। বারসিক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, কর্মশালা, উঠান বৈঠিক, মতবিনিময় সভা ও জনসংগঠনের সভায় হাওরের কৃষকদের জৈব সার ও ভেষজ কীটনাশক উৎপাদন ও ব্যবহারের সচেতন করে আসছে। বারসিক কৃষকদেরকে কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন করে সবজি ও অন্যান্য শস্য ফসলের জমিতে ব্যবহার করে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনা এবং মাটির গুণাগুণ ঠিক রেখে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের উৎসাহিত করে আসছে।
বারসিক মদন সদর ইউনিয়ন ও গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নের জৈব উপায়ে চাষাবাদে আগ্রহী ১০ জন কষককে নির্বাচন করে পরীক্ষামূলকভাবে কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদনের জন্য উপকরণ সহায়তা প্রদান করে। নির্র্বাচিত ১০ জন কৃষককে বারসিক’র সহায়তায় ৪টি করে সিমেন্টের রিং ও উপড়ে চালা দেয়ার জন্য ৮ গজ করে পলিথিন শীট প্রদান করা হয়। উপকরণ সহায়তা প্রদানের পর কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহার বিষয়ে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির জন্য গত ৯ মার্চ নির্বাচিত ১০ জন কৃষককে নেত্রকোনা সদর উপজেলার চল্লিশা ইউনিয়নের রাজেন্দ্রপুর কম্পোস্ট গ্রাম পরিদর্শনের জন্য দিনব্যাপী এক অভিজ্ঞতা বিনিময় সফরের আয়োজন করা হয়। সফরকারী দল সকাল ১১:০০ টায় রাজেন্দ্রেপুর কম্পোস্ট গ্রামে রাজেন্দ্রপুর আইপিএম ক্লাবে পৌছালে ক্লাবের সভাপতি কৃষক বাদশা মিয়া ও কৃষাণী কুসুমা আক্তারসহ সংগঠনের সদস্যরা তাদেরকে স্বাগত জানায়। কৃষক বাদশা মিয়া ও কৃষাণী কুসুমা আক্তার প্রথমে সফরকারীদেরকে রাজেন্দ্রপুর কম্পোস্ট গ্রাম সম্পর্কে এবং কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা দেন। অতপর বাদশা মিয়া ও কুসুমা আক্তারের নেতৃত্বে সফরকারীদেরকে সরেজমিতে কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন খামারে নিয়ে বিস্তারিতভাবে কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে শেখানো হয়। কৃষকরা কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদনের গোবর ও অন্যান্য কাঁচামাল এবং কেঁচো ও উৎপাদিত কম্পোস্ট হাত দিয়ে পরীক্ষা ও যাচাই করে দেখেন। সরেজমিনে কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন খামার পরিদর্শন শেষে সফরকারী কৃষকরা রাজেন্দ্রপুর আইপিএম ক্লবের সদস্যদের সাথে এক অভিজ্ঞতা বিনিময় সভায় অংশগ্রহণ করেন।
অভিজ্ঞতা সহভাগিতা করতে গিয়ে কৃষক বাদশা মিয়া বলেন, ‘আমি আমার র্৪*র্৪ চারটি হাউজ থেকে বছরে প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকার অধিক কম্পোস্ট ও কেঁচো বিক্রি করি। কম্পোস্ট উৎপাদনে পরিশ্রমের মধ্যে প্রতিদিন সকলে গোয়ালের গোবর সংগ্রহ করে হাউজে ফেলা এবং কম্পোস্ট সংগ্রহের সময় হলে চালনি দিয়ে চেলে কম্পোস্ট ও কেঁচো আলাদা করা। এ কাজ আমি ও আমার স্ত্রী দু’জনে মিলে করি। কম্পোস্ট ও কেঁচো বাড়ি থেকে কিনে নিয়ে যায়। অনেক সময় কৃষি অফিস ও অন্যান্য এনজিওরা অর্ডার দিলে তাদের কাছে কম্পোস্ট ও কেঁচো পৌছে দিই। আমাদের গ্রামের সবগুলো পরিবারই কেঁচো কম্পো¯ট উৎপাদন করে এবং তা দিয়ে রাসায়নিক সার ও বিষমুক্ত উপায়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করে। ঢাকার পাইকাররা প্রতি সপ্তাহে আমাদের গ্রাম থেকে বিষমুক্ত নিরাপদ সবজি, ডিম ও দুধ কিনে নিয়ে যায়। আমরা প্রতি কেজি কম্পোস্ট ১০/১২ টাকা কেজি এবং কেঁচো ১০০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করি। কম্পোস্ট এবং কেঁচোর চাহিদাও অনেক এবং এ চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।’ কৃষাণী কুলসুমা আক্তার বলেন, ‘নারীরা যেহেতু ঘরের কাজ করে এবং সকালে গোয়ালের গরু বের করা ও গোবর ফেলার কাজ গ্রামের নারীরাই করে থাকে, তাই কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন করা নারীদের জন্য সুবিধার। আমাদের গ্রামের নারীরা কম্পোস্ট উৎপাদনের সকল কাজ করে থাকে। কম্পোস্ট দিয়ে উৎপাদিত সবজি খেতেও খুব সুস্বাদু এবং বাজারে চাহিদা ও মূল্য উভয়ই বেশি।
হাওরাঞ্চলের নারীরা সহজেই কেচো কম্পোস্ট উৎপাদন করে অনেক আয় করতে পারে।’
সফরকারী কৃষক দলের সদস্য কৃষক তাজুল ইসলাম বলেন, ‘কেঁচো কম্পেস্টের কথা এবং এর উপকারীতার কথা অনেক শুনেছি। আমি বছরের প্রায় ছয় মাস (পানি আসার আগে পর্যন্ত) বিভিন্ন ধরণের সবজি চাষ করি, তাই বারসিক ও কৃষি বিভাগ আমাকে জৈব উপায়ে নিরাপদ সবজি উৎপাদনের পরামর্শ দেয়। বারসিক কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদনের জন্য আমাকে চারটি সিমেন্টের রিং ও পলিথিন শীট দিয়েছে। কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন খামার পরিদর্শন করে এবং উৎপাদন পদ্ধতি সম্পর্কে জানার পর আমার জন্য কম্পোস্ট উৎপাদন করা এখন সহজ হবে।’
সফরকারী কৃষকরা গ্রামে ফিরে গিয়ে পুরোদমে কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদনে মনোযোগ দিবেন বলে জানান এবং জৈব উপায়ে বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ করে নিজেদের এবং ভোক্তাদের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেন।
………