দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি এবং প্রান্তিক কৃষকের প্রচেষ্টা

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
বিশ^বাজার, অর্থনীতি, বৈশি^ক মন্দা এসকল কঠিন বিষয়গুলো গ্রামীণ সাধারণ জনগোষ্ঠী বোঝেন না। তাঁরা বোঝেন সময়মতো চাষাবাদ করা, পরিবারের সবাইকে নিয়ে তিনবেলা পেটপুড়ে খাবার খাওয়া। কিন্তু বর্তমান সময়ে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের দিনযাপন কষ্টকর হয়ে উঠেছে। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন প্রান্তিক শ্রেণির কৃষক। কারণ তাঁদের আবাদী জমির পরিমাণ কম, কেউ কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। তবে ধনী শ্রেণির কৃষকদের তেমন কোনো সমস্যায় পড়তে হয়না।


আমাদের গ্রামীণ পরিবারগুলোর বাড়ির আঙিনা, পুকুর পাড়, পতিত জায়গা সবই হলো সুফলা। এখানে বিভিন্ন ধরণের আবাদি, অনাবাদি ফসল ফলে। এছাড়া বাড়িতে পালিত প্রাণিসম্পদ, ডিম, মাছ খাবার হিসেবেও গ্রহণ করেন। পরিবার ছাড়াও বাড়িতে কোনো অতিথি এলে তাঁদের আপ্যায়নের জন্যও এগুলোই ভরসা। আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে গেলেও হাতে থাকে নানা ধরণের সব্জি, মুরগি বা হাঁস, ফল ইত্যাদি। অনেক সময় আবার বাড়ির ছোট সদস্যদের উপহার হিসেবে কেউ প্রাণিসম্পদও দিয়ে থাকেন। গ্রাম বাংলার পরিবারগুলোর এই চিরায়ত প্রথা দীর্ঘ দিন ধরে প্রচলিত।


খাবারের সকল উপকরণ নিজের বাড়িতে থাকলেও অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণ বাজার থেকেই কিনতে হয়। কিন্তু বাজারে সব ধরণের পণ্য সামগ্রীর অতিরিক্ত মূল্য বৃদ্ধির কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তাঁদের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণে হিমশিম খাচ্ছেন। কিন্তু তাই বলে জীবনযাপন তো আর থেমে থাকবেনা। সমস্যা যেমন আছে, সমাধানও আছে। বাজারে যেমন আছে মূল্যবৃদ্ধি, কৃষকেরও আছে নিজস্ব জ্ঞান, অভিজ্ঞতা আর চর্চা।


একজন কৃষকের সম্পদ হচ্ছে তাঁর ফসল, প্রাণিসম্পদ। নিজের পরিবারের সদস্যদের অন্যান্য চাহিদা পূরণ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, আত্মীয়তা রক্ষায় আচার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ এসব কিছু তাঁরা করেন কৃষিজ সামগ্রী বিক্রির অর্থের সাহায্যে। আবার যেসকল উপকরণ তাঁদের কিনতে হয় সেগুলো কেনার জন্য নিজেদের কৃষি ফসলই ভরসা। এগুলো বিক্রির অর্থ দিয়ে তাঁরা প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে আনেন। তাছাড়া অনেক সময় শখের বশেও কিছু খাদ্যোপকরণ বাজার থেকে কিনে থাকেন।


কিন্তু চলমান সময়ে বাজার মূল্যের উর্ধ্বগতির সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে কৃষকগণ নিজেদের মতো করে কিছু কৌশল অবলম্বন করতে শুরু করেছেন। এসবের মধ্যে ফসল উৎপাদন, প্রাণিসম্পদ পালন, মাছ চাষ ইত্যাদির পরিমাণ বৃদ্ধি করেছেন। অনেক কৃষক আগে নিজেদের পুকুর পাড়, রাস্তার দুই কিনারা, বসত বাড়ির উঠান এসমস্ত জায়গা গুলো কোনো কাজে ব্যবহার করতেন না। কিন্তু এখন সে সমস্ত জায়গায় বিভিন্ন ধরণের ফসল যেমন ডাটা, মরিচ, শিম, বেগুন, পাটশাক ইত্যাদি চাষাবাদ করছেন। আবার অনেক কৃষকের বাড়িতে হাঁস, মুরগি পালন বৃদ্ধি এবং অনেকে নতুন করে পালন শুরু করেছেন। অচাষকৃত শাক যেমন হেইচা, কচুশাক ইত্যাদি সংগ্রহ করে খাওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি করেছেন।


লক্ষীগঞ্জ ইউনিয়নের চকপাড়া গ্রামের মাহমুদা আক্তার, হালিমা আক্তারের নিজের পুকুর নেই। তাই কখনো হাঁসের বাচ্চা পালন করেননি। কিন্তু এবছর প্রতিবেশির কাছ থেকে হাঁসের বাচ্চা কিনেছেন। বাড়ির পাশের ডোবা, জমিতে সেচের নালায় ছোট বাচ্চাগুলোকে ছেড়ে রাখেন। কান্দাপাড়া গ্রামের মালা আক্তার, দিলুয়ারা আক্তার, সুলতানগাতী গ্রামের হলুদা আক্তার, শাহানা আক্তার, সানকিউড়া গ্রামের নারগিস আক্তারসহ অসংখ্য পরিবারের কৃষাণীগণ নতুন করে হাঁস পালন শুরু করেছেন। এগুলোর খাবার হিসেবে হেইচা শাক, লাউয়ের পাতা ব্যবহার করেন।
তাঁদের কথা অনুযায়ী জানা যায়, গত বছরেও একজোড়া পূর্ণ বয়স্ক হাঁসের দাম ছিল ৪৫০/৫০০ টাকা। কিন্তু এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০০ টাকা। কৃষাণীরা আরো বলেছেন, বেশি দামে ডিম বিক্রি করার চাইতে হাঁস বিক্রি করা লাভজনক। পরিবারে চাহিদা পূরণ করে বাড়তি ডিম আগে বিক্রি করে দিতেন। কিন্তু এখন সেই ডিম দিয়ে বাচ্চা ফোটান। উক্ত ইউনিয়নের ৬টি গ্রামের ১৫টি পরিবারে হাঁস পালন করতে শুরু করেছেন।


মুরগি পালন করতে তেমন জায়গা বা পুকুরের প্রয়োজন হয়না। তাই প্রতিটি পরিবারে কম বেশি মুরগি পালন করা হয়ে থাকে। বিগত বছরেও বিভিন্ন গ্রামে শুধু জমিতে পাট চাষ করা দেখা গেছে। কিন্তু এবছর প্রায় প্রতিটি গ্রামের যে বাড়ির বসতভিটা বা পুকুর পাড়ে সামান্য জায়গা আছে সেখানে পাট চাষ করে পরিবারের খাবারের চাহিদা পূরণ করছেন। লক্ষীগঞ্জ ইউনিয়নের সুলতানপুর, জয়শিদ, নসিবপুরসহ ৭টি গ্রামে ১২টি পরিবারে এবছর নিজের বাড়ির উঠানে ও পুকুর পাড়ে পাটশাক চাষ করতে দেখা যায়।


পুকুর পাড়ে, রাস্তার পাশে, মরিচ ক্ষেতে অচাষকৃত শাক জন্মাতে দেখা যায়। গ্রামের কৃষাণীরা এসব কুড়িয়ে নিয়ে রান্না করতেন। এখনো করেন। আগে হয়তো পরিবারের ছোট সদস্যরা এই খাবারগুলো তেমন পছন্দ করতোনা। কিন্তু এখন পরিবারের সবাই মিলে খেয়ে থাকেন। আতকাপাড়া গ্রামের প্রান্তিক কৃষক পরিবারের জবা আক্তার, রামপুর গ্রামের কবিতা আক্তারসহ ৫টি গ্রামের ৮টি পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে প্রতিটি পরিবারে অচাষকৃত শাক রান্না করে খাওয়ার কথা জানা গেছে।


গত বছরের তুলনায় এবছর মরিচের দাম প্রায় দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যাদের মরিচ চাষের জমি নেই তাঁরা বাজার থেকে মরিচ কিনে সারাবছর ব্যবহার করতেন। কিন্তু এবছর তাঁরা নিজের বাড়ির উঠানের একপাশে, পুকুর পাড়ের অব্যবহৃত জায়গায় মরিচের চাষ করেছেন। অনেক কৃষাণী আবার অন্যান্য ফসলের সাথে মরিচের আবাদ করেছেন। কান্দাপাড়া গ্রামের হাসিনা আক্তার, বাইশদার গ্রামের প্রতিভা রানী, নান্টু দাস তাঁরাসহ মোট ৯টি গ্রামের ১৩জন কৃষক চলতি মৌসুমে প্রথমবারের মতো মরিচের চাষ করেছেন।


তাছাড়া কৃষকগণ বিভিন্ন সব্জীর বীজ বেশি পরিমাণে সংরক্ষণ করতে শুরু করেছেন। যাতে একই ফসল দুইবার চাষ করা যায়। এবং একই জমিতে অনেক ধরণের ফসল আবাদও কোনো কোনো কৃষকের চর্চায় নতুন করে যুক্ত হচ্ছে। কান্দাপাড়া, চকপাড়া, গদাইকান্দি ও আতকাপাড়া গ্রামের ৪জন কৃষক এধরণের চর্চা করছেন।


বিক্রির মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের চাইতে নিজের পরিবারের চাহিদা পূরণ, পরিবর্তিত পরিস্থিতির মোকাবেলা করা এবং বাজার নির্ভরশীলতা কমানোর উদ্যেশ্যেই বিভিন্ন গ্রামের প্রান্তিক কৃষকগণ নানা কৌশল অবলম্বন করছেন। কৃষকদের এই ধরণের উদ্যোগের ফলে বৈচিত্র্যতা বৃদ্ধির পাশাপাশি পতিত জায়গাগুলো চাষের আওতায় এসেছে। কৃষকদের এধরণের চর্চা অব্যহত থাকলে তাঁদের পাশাপাশি অন্যান্য পেশাজীবি মানুষেরাও এগিয়ে আসবেন। একে অপরের প্রতি নির্ভরশীলতার সমন্বয়ে গড়ে উঠবে বহুত্ববাদী সমাজ।

happy wheels 2

Comments