সাম্প্রতিক পোস্ট

মাটিকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চান সুবল পাল

নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা
পৌষের শুরু অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর শীতের আগমন কিছুটা পিছিয়ে গেলেও শীতের মিষ্টি রোৗদ্র ছায়ার খেলার শেষ হয়নি। কুয়াশা ভেদ করে রৌদ্রের তেজ বাড়ির উঠানে বানানো মাটির তৈরি সরস্বতী প্রতিমার মাটির তৈরি শরীরে লাগার আগেই সূর্য্য মামার বাড়ি ফেরার তাড়া।


সকাল সন্ধ্যা রৌদ্র ছায়ার খেলার মধ্যে নিজেদের তৈরি হাড়ি পাতিল শুকানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন আমতলা ইউনিয়নের কুমার পাড়ার নারীরা। কুমার পাড়ার নারীরা হাড়ি পাতালি নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও সুবল চন্দ্র পালের বাড়ির চিত্র একেবারে ভিন্ন। বর্তমানের সুবল পালের বাড়ির উঠান, বাড়ির রাস্তা, ঘরে ভিতরে যেপাশে তাকানো যায় সবদিকে তৈরি হচ্ছে সরস্বতী প্রতিমা। ভিন্ন গ্রাম থেকে চৌদ্দ, পনেরো বছরের চার পাঁচ জন ছেলেরা মনোযোগ দিয়ে প্রতিমা তৈরি করছে। হলুদ লুঙ্গি, কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল ওয়ালা, ছিপছিপে সুবল পাল হাত ধরে মূর্তি তৈরির কৌশল দেখিয়ে দিচ্ছেন।


সুবল পাল নেত্রকোনা জেলা সবচেয়ে বড় প্রতিমা তৈরির কারিগর । প্রায় ৩০ বছর আগে গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈল উপজেলার থেকে জীবিকার প্রয়োজনে বাবা জয়নাথ পালের সাথে নেত্রকোনা জেলার আমতলা ইউনিয়নের আমতলা গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন। শুরুতে গ্রামে এসে পিতার সাথে হাড়ি পাতিল তৈরি করে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিক্রি করতেন। পৌষমেলা, চৈত্র সংক্রান্তি, বৈশাখি মেলায় বিক্রয়ের জন্য বিভিন্ন রকম মাটির খেলনা তৈরী করতেন পরিবারের সবাই মিলে। সুবল পালের হাতের তৈরি খেলনা বা হাড়ি পাতিল স্থানীয় মানুষের খুব পছন্দের থাকলেও তিনি সব সময় নতুন কিছু করার চেষ্টা করতেন ।


নেত্রকোনা ও নেত্রকোনার বাইরে সুবল পালকে মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে যে প্রতিমা তৈরি করেন সে শিক্ষা লাভ করেন নিজের আপন চাচাতো ভাই রাম গোপাল পালের নিকট থেকে। যিনি মাটির ভাসকর্য্য তৈরি করে বিভিন্ন সময় সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে পুরষ্কার পেয়েছেন। রাম গোপালের সাথে নেত্রকোনা, ঢাকায় ভিন্ন স্থানে মূর্তি তৈরির কাজ করে কিছুদিনের মধ্যে এ কাজে দক্ষ হয়ে উঠেন তিনি। বিশেষ করে দূর্গা প্রতিমা তৈরির মাধ্যমে তিনি নেত্রকোনা ও নেত্রকোনার বাইরে সকল পেশার মানুষের নজর কাড়েন। তিনি মূর্তি তৈরির পাশাপাশি বাংলার প্রাণ ও প্রকৃতিকে বিভিন্ন মাটির নকশায় উপস্থাপন করে থাকেন।


বর্তমানে সুবল পাল একজন দক্ষ মৃত শিল্পের গুরু। প্রতিবছর বিভিন্ন জায়গা থেকে যুবরা এসে মূর্তি ও খেলনা তৈরির শিক্ষা নিয়ে থাকে। নিজ গ্রামের অনেক নারী যারা কখনো মাটির কাজ করেনি তারাও খেলনা তৈরীর কাজ শিখে এ কাজটিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন।


মাটির উপকরণ ও মূর্তি তৈরি করার জন্য প্রয়োজন হয় ধানের খেড়, এটেল ও বেলে মাটি, নানা রঙ। এক সময় নদীর পার খোলা, অনাবাদী জমি থেকে মাটি সংগ্রহ করতেন। মানুষে মানুষে সম্পর্কের ভিট এতটা মজবুত ছিল যে মাটি সংগ্রহ করতে শুধু জমির মালিকের সাথে মৌখিক আলোচনায় যথেষ্ঠ ছিল। এখন সব কিছু বদলে গেছে।
জমির মালিকের নিকট থেকে ফুট হিসেবে মাটি কিনতে হয়। যত টাকার মাটি কিনেন তার চেয়ে বেশি টাকা দিয়ে গাড়ি ভাড়া করে মাটি আনতে হয়। ধানের সাথে সাথে বেড়ে গেছে প্রতি কাঠা বন /খেড়ের দাম। আর্থিক খরচের চেয়ে বর্তমানে মূর্তি তৈরির ক্ষেত্রে বড় সমস্যা মূর্তি তৈরির জন্য যে ধরনে এটেল ও বেলে মাটি প্রয়োজন সে ধরনে মাটি পাওয়া যায় না । প্রথমে এটেল মাটি দিয়ে মূর্তি তৈরি করে খুব নিখুঁতভাবে বেলে মাটির প্রলেপ দিয়ে মূর্তির প্রকৃত রুপ দিতে হয়ে কিন্তু বর্তমানে যে মাটি পাওয়া যায় তা এতটা খসখসে যে শুকানোর পর মূর্তি উপর ভাগটা ফেটে যায়। এতে করে বারবার প্রলেপ দিতে হয়। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমাদের দেশে আবহাওয়া যেমন বদলাইছে সেই সাথে ঋতু বদলে গেছে বদলাইছে নদীর পানি প্রবাহ। সেই সাথে অধিক পরিমাণ সার, বিষ ব্যবহার মাটি তামা করে দিচ্ছে। শুধু মাটির জন্য এ পেশা টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়ছে ভবিষ্যতে।”


উপকরণে সাথে সাথে যাদেরকে নিয়ে তিনি প্রতিমা তৈরি করেন তাদের মজুরী বেড়েছে, বাড়েনি শুধু পুজা বিক্রয় মূল্য। এক একটি মূর্তি তৈরির জন্য ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়। কিন্তু যারা অর্ডার দেন তারা খুব কম টাকায় বায়না করেন। ফলে ঋণ করে টাকা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আরও ক্ষতির স¤ু§খিন হতে হয়। সুবল পালের প্রতিমা তৈরির কাজে অনেকে খুশি হয়ে মাঝে মাঝে সহায়তা করেন।


সুবল পাল শুধু খেলনা বা প্রতিমা তৈরির মাঝে নিজের শিল্প চর্চাকে সীমাবদ্দ রাখতে চান না। তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন সনামধন্য ব্যক্তির ভাস্কর্য তৈরি করে দেশের সর্বস্তরের মানুষের মাঝে বেঁচে থাকতে চান। এ জন্য প্রয়োজন বিত্তশালি ব্যক্তিবর্গে সুনজর ও সরকারি-বেসরকারী সংস্থার সহায়তা। জীবনের পঞ্চাশটি বছর পার করলেও সেদিন এক সময় আসবে বলে মনে করেন তিনি। তাই হাজার দুঃখ কষ্টের মাঝেও মাটি আঁকড়ে বেঁচে থাকতে চান। সেই সাথে নিজের এ শিল্পকে নতুন প্রজন্মের মাঝে রেখে যেতে চান ।

happy wheels 2