সকল প্রাণের জন্য চাই খাদ্যনিরাপত্তা

এক.
দার্শনিক লুডভিগ ফয়েরবাখের মতে, ‘মানুষ তাই, যা সে খায়’। নাট্যকার জর্জ বার্নাড শ বলেন, ‘খাদ্যের প্রতি প্রেমের মতো বিশ্বস্ত প্রেম আর হয় না’। বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন বলেন, ‘মানবস্বাস্থ্যের জন্য এবং পৃথিবীতে মানব প্রজাতির টিকে থাকার জন্য নিরামিষাশী হওয়ার চেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারে না।’ খাদ্যকে ঘিরে ছড়িয়ে আছে কত না চিন্তা, শর্ত আর কাহিনী। কিন্তু আমরা যখনই খাদ্যের কথা বলি, তখন কেবলমাত্র মানুষের খাদ্য ও পানীয় নিয়েই কথা বলি। বাদ থেকে যায় পাখি, মাছ, গাছ, কেঁচোসহ প্রকৃতির অন্যান্য প্রাণসত্তার কথা। এমনকি নিরাপদ খাদ্য ও খাদ্য নিরাপত্তার প্রসঙ্গেও বাদ থেকে যায় মাটি, জল, অরণ্য, পাহাড়ের খাদ্য নিরাপত্তার কথা। ষাটের দশকে প্রবর্তিত রাসায়নিক সার, বিষ, যন্ত্রচালিত সেচ ও উচ্চফলনশীল বীজের মাধ্যমে প্রবর্তিত ‘সবুজ বিপ্লবের’ মূল চিন্তাই ছিল কেবলমাত্র মানুষের জন্য অধিক হারে খাদ্য উৎপাদন। সেই খাদ্য উৎপাদন করতে গিয়ে মাটি, পানি ও গাছের শরীরে ঢালতে হয়েছে বিপদজনক রাসায়নিক বিষ। খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে মজুত ও প্রক্রিয়াজাতকরণ সকল স্তরে প্রচলন ঘটেছে হরমোন, কার্বাইড কি ফরমালিনের মতো স্বাস্থ্যবিনাশী রাসায়নিকের। প্রকৃতি থেকে কেঁচো, শামুক, ব্যাঙ, কুঁচে, মাকড়সা, মৌমাছি, মাছ ও পাখিদের তাড়িয়ে আজ দাঁড়িয়েছে প্রকান্ড এক ‘খাদ্য কারখানা’ ও একতরফা বহুজাতিক বাণিজ্য। কেবলমাত্র মানুষের জন্য খাদ্য উৎপাদন করতে গিয়ে প্রকৃতির অপরাপর প্রাণসত্তার খাদ্যকে বিষাক্ত ও নির্মূল করা হচ্ছে। প্রকৃতির খাদ্যজালে তৈরি হয়েছে চরম বিশৃংখলা ও খাদ্য সংকট। মাটি ও পানির স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে, তাদের পর্যাপ্ত খাদ্যের যোগান না থাকলে কীভাবে মানুষসহ প্রকৃতির অপরাপর সদস্যদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে? আজ তাই প্রকৃতিতে সর্বত্র, সকল সদস্যই খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় পড়তে বাধ্য হয়েছে। প্রতিবেশগত, প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ের পাশাপাশি সাম্প্রতিক জলবায়ু সংকটের এই সময়ে এই খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা আরো চরম ও জটিল আকার ধারণ করছে। এটি আজ স্পষ্ট হয়েছে, শুধুমাত্র মানুষের একার জন্য কোনো খাদ্য কোনোভাবেই নিরাপদ হতে পারে না এবং প্রকতির অপরাপর সদস্যদের বাদ রেখে কোনোভাবেই মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হতে পারে না। তাই আজ আমাদের সকলকেই মানুষসহ প্রকৃতির সকল প্রাণের জন্যই খাদ্য নিরাপত্তার দাবি তোলা জরুরি। আর সকলের কাংখিত ও নিরাপদ খাদ্যের যোগফলই খাদ্য নিরাপত্তার পরিস্থিতি তৈরি করবে।

দুই.
খাদ্য কোনোভাবেই কেবলমাত্র একটিমাত্র একক প্রজাতির উপর নির্ভর করে না, এর সাথে অপরাপর প্রজাতিরাও জড়িত। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের চৈলতাছড়ার আদিবাসী খাসি পুঞ্জি খাদ্যের এমন বহুমাত্রিকতার একটা ছোট উদাহরণ টানা যাক। চৈলতাছড়ার জংগলে জন্মায় সহরহং নমের এক ধরনের বুনো ডুমুর। গাছটি খাসি আদিবাসীদের লতানো পান চাষের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই ফলটি পাকা অবস্থায় মানুষ খেতে পারে। ফলটি গাছে থাকা অবস্থায় পিঁপড়া ও ছোট পোকামাকড় এর থেকে রস খায়। বনের নিচুস্তরের পাখিরাও ডুমুর খায় এবং পাখিদের মাধ্যমে এর বীজ বিসরন ঘটে এবং নতুন চারা গজায়। ডুমুর গাছটিও একসময় নানান পতঙ্গের খাদ্যে পরিণত হয় এবং ধীরে ধীরে মরে গিয়ে মাটির সাথে মিশে যায়। একসময় মাটি থেকে খাদ্য নিয়ে বেঁচে থাকা মৃত ডুমুর গাছ তখন নিজেই মাটিকে খাদ্য যোগায়। ডুমুর বীজ থেকে গজানো নতুন চারাকে আবার মাটিই বড় করে তুলে। এভাবেই এক ডুমুরের সাথে মানুষ, পতঙ্গ, মাটি ও পাখিদের এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠেছে। আলাদা আলাদাভাবে শুধুমাত্র পতঙ্গ বা পাখি বা মাটি বা মানুষের খাদ্যের নিরাপত্তা কী সম্ভব? এমনকি প্রকৃতির এই জটিল খাদ্যজালের একটি সদস্য যদি খাদ্যহীনতায় পড়ে তবে এর প্রভাব কিন্তু সকলকেই টানতে হবে। এই উদাহরণ আমরা দেশের যেকোনো প্রান্তে যেকোনো প্রজাতির খাদ্য ঘিরে টিকে থাকা বৈচিত্র্যময় সম্পর্কের দিকে তাকালেই দেখতে পাবো। কথা হচ্ছে আমরা প্রাণ ও প্রকৃতির এই বৈচিত্র্য ও আন্তঃনির্ভরশীল সম্পর্ককে শ্রদ্ধা করি কিনা, গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করি কিনা। নাকি খুব মোটাদাগে খাদ্যকে বারবার ওজনের দরে বা ক্যালোরির অংক দিয়ে হিসাব করে যাবো? এভাবে কী সকলের খাদ্য নিরাপত্তা সুরক্ষিত হয়?

তিন.
খাদ্যের জন্য মানুষসহ প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণসত্তারই অবিরাম সংগ্রাম ঐতিহাসিক। কারণ খাদ্যই সকল প্রাণসত্তাকে টিকে রাখবার শক্তি যোগায়। সুকুমারী ভট্টাচার্য (২০০০) তাঁর বেদের যুগে ক্ষুধা ও খাদ্য বইতে বেদগ্রন্থের শ্লোকসমূহের ব্যাখা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, বৈদিক যুগেও সমাজে খাদ্যাভাব ও অন্নের সংকট ছিল। ছিল খাদ্যের জন্য প্রার্থনা। তাই দেখা যায় খাদ্য ঘিরেই তৈরি হয় নানা বাণিজ্যিক বিস্তার থেকে শুরু করে আকাল ও দূর্ভিক্ষের মতো সামাজিক অন্যায্যতা। জিওফ তানশি (২০০৮) তাঁর ‘দ্য ফিউচার কন্ট্রোল অব ফুড’ বইতে একটি পরিসংখ্যান দিয়েছেন, সারা দুনিয়ায় যেমন ৮৫০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ অপুষ্টির শিকার সেখানে আবার প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ অতিরিক্ত ওজন নিয়ে দিন কাটাচ্ছে যার ভেতর প্রায় ৩০০ মিলিয়ন অতিরিক্ত স্থূলতায় ভুগছে। ২০১৫ সনের ‘বিশ্ব ক্ষুধা সূচক’ অনুযায়ী বিশ্বের প্রায় ৭৯ কোটি ৫০ লাখ মানুষের জন্য পর্যাপ্ত খাবার নেই এবং খাদ্য সংকটে থাকা ৯৮ ভাগ মানুষই উন্নয়নশীল দেশের বাসিন্দা। কিন্তু বরাবরই খাদ্য নিরাপত্তা বলতে কেবলমাত্র মানুষেরই খাদ্য বোঝায়। আমরা কখনোই পশু, পাখি গাছপালা নদী পাহাড়ের খাদ্য সংকটের প্রসঙ্গ আলোচিত হতে দেখি না। বরং আমরা দেখতে পেয়েছি ২০০৯ থেকে ২০১২ পর্যন্ত বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবনের বাঘ খাদ্য সংকটে ভুগে বনসংলগ্ন মানুষের গ্রামে ঢুকে প্রাণ দিয়েছে, এমনকি ক্ষুধার্ত বাঘও বনের ভেতর বনজীবীদের আক্রমণ করে মেরেছে। কেবল বাঘ নয়, সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার মানুষও কৃষিসহ নিজস্ব উৎপাদন অধিকার হারিয়ে পাড়ি দিচ্ছে এক দীর্ঘ খাদ্য-যন্ত্রণা। অনেকেই বলে থাকেন খাদ্য নাকি এক অব্যর্থ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মারণাস্ত্র। এমনকি খাদ্যের রয়েছে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ব্যঞ্জনা। মানুষসহ প্রকৃতির সকল প্রাণসত্তারই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন খাদ্য তালিকা ও খাদ্য রুচি। এর ভেতর দিয়েই দেশের নানাপ্রান্তে গড়ে ওঠেছে বৈচিত্র্যময় খাদ্যসংস্কৃতি। দেশের হাওরাঞ্চলে সুগন্ধি চিকন আতপ চাল খাওয়ার চল, আবার দক্ষিণাঞ্চলে মোটা ধানের সিদ্ধ চাল জনপ্রিয়। সাধারণত বাঙালি রান্নায় তুলনামূলকভাবে তেল-মশলা বেশি ব্যবহৃত হয়, অপরদিকে আদিবাসী রান্নাগুলোয় অনেক কম। তারপরও খাদ্য-রুচি বলতে মানুষের কথাই সবসময় প্রধান করে তোলা হয়। আমরা বিশুদ্ধ ভেজালমুক্ত খাঁটি দুধ খেতে চাই। হয়তো দুধে জল বা ফরমালিন কোনো কিছুই মেশানো হল না। কিন্তু সেই গরু যে ঘাস খাচ্ছে বা যে মাটিতে ঘাস জন্মাচ্ছে তা ঐ গরুর জন্য কতটা নিরাপদ? আমরা মানুষ হিসেবে নিজেদের পুষ্টি নিরাপত্তার জন্য আরো বেশি দুধ চাই, কিন্তু একটিবার কী ভাবি যে গরু দুধ দেয় তার পর্যাপ্ত পুষ্টিকর নিরাপদ খাবারের যোগান আছে কিনা। প্রাণিসম্পদের জন্য যথেষ্ট চারণভূমি আছে কিনা। নগরায়ণ, শিল্পায়ন আর তথাকথিত উন্নয়নের নামে মানুষের কথা চিন্তা করেই আজ পশু-পাখির সকল চারণভূমি আর জলাভূমি আমরা দখল ও দূষিত করে রেখেছি। তাহলে আমাদের গরু, ছাগল, শুকর, মুরগি, হাঁস, ভেড়া তারা খাবে কোথায়? পশুপাখিদের খাদ্যক্ষেত্র দখল করে শুধুমাত্র মানুষের খাদ্য উৎপাদনের ভেতর দিয়ে তাহলে কীভাবে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হতে পারে? এই প্রশ্ন আজ জাতীয়ভাবে তোলা জরুরি। খাদ্য সম্পর্কিত আইন ও নীতি সকল ক্ষেত্রেই সকল প্রাণসত্তার জন্য খাদ্য নিরাপত্তার এই চিন্তাকে যুক্ত করা জরুরি।

চার.
খাদ্য নিরাপত্তা এখনও পর্যন্ত একটি সর্বজনগ্রাহ্য ধারণা নয়। একটি দেশের খাদ্য উৎপাদন ক্ষমতাকে খাদ্য নিরাপত্তা বোঝায় না। বিশ্ব খাদ্য উৎপাদন, বাণিজ্য নীতি, বাণিজ্য সম্পর্কিত চুক্তি, কৃষি সম্পর্কিত আইন ও নীতি, আয় সংক্রান্ত ধারা এবং সামাজিক নিরাপত্তাসমূহ সবই খাদ্য নিরাপত্তার সাথে সম্পর্কিত। এদেশে সমানে খাদ্য উৎপাদনের প্রাকৃতিক ভূমি কৃষি, জুমের জমিন, চারণভূমি ও জলাশয় দিনদিন দখল হয়ে যাচ্ছে। খাদ্য চাহিদা মেটাতে তৈরি হচ্ছে বহুজাতিক খাদ্য বাজার এবং চুক্তিভিত্তিক কৃষি খামার। ‘আধুনিক পদ্ধতিতে’ অতিরিক্ত ফসল উৎপাদনের ফলে মাটির পুষ্টি উপাদান দিন দিন কমে যাচ্ছে। এ কারণে মাটির পুষ্টি চাহিদাও বেড়ে যাচ্ছে আনুপাতিক হারে। তৈরি হচ্ছে নানাবিধ স্বাস্থ্যগত ও প্রতিবেশগত সমস্যা। তারপরও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের একমাত্র রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি ও দর্শন কেবলমাত্র মানুষের জন্য অধিক খাদ্য উৎপাদন। খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে অধুনালুপ্ত লালমনিরহাটের পাটগ্রামের ছিটমহলের এক প্রবীণ বাঙালি কৃষকের কথা টেন আনা যাক। তিনি জানান, যখন কৃষকের হাতে খাদ্যের লাটিম থাকবে, কৃষক যখন তা নিজের মত ঘুরাতে আর বন্ধ করতে পারবে তখনইতো নিরাপত্তা হবে। একজন খাবে আরেকজন না খেয়ে থাকবে এটি কোনোভাবেই নিরাপত্তা হতে পারে না।

আমরা আজ সমাজ ও সভ্যতার এক সংকটময় মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছি। মাতৃদুনিয়ার প্রাণ ও প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় সম্পর্ক ও একে অপরের উপর নির্ভরশীলতার সূত্র গুলো থেকে নিজেদের সরিয়ে নিচ্ছি অকৃতজ্ঞের মতো। প্রকৃতির ভেতর মানুষই খাদ্যের উপর শতভাগ অন্যের উপর নির্ভরশীল। আর মানুষই খাদ্যের জন্য দাঙ্গা থেকে যুদ্ধ সবই বাঁধাতে পারে। উন্মত্ত, মরিয়া ও সহিংস হয়ে ওঠতে পারে। মানুষই শামুক, কেঁচো, পাখি, মাছ কি গাছের মুখের আহার কেড়ে একতরফাভাবে নিজের উদরপূর্তি করতে পারে। খাবারের জন্য মানুষের এই মরিয়া হয়ে ওঠাকে থামাতে হবে। প্রকৃতির অপরাপর প্রাণসত্তার উপর সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। শুধু মানুষের জন্য নয়, পৃথিবীর সকল প্রাণত্তার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তাই মানুষকেই অধিকতর দায়বদ্ধ ও দায়িত্বশীল হতে হবে। সকলের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের এই বার্তা ও শপথ নেই আসুন আমরা সকলে, একসাথে। আজকের তরুণ প্রজন্মই এই খাদ্য নিরাপত্তা যাত্রাকে সফল করে তুলতে পারে। আমাদের সকল খাদ্য সম্ভাবনা ও স্বপ্নকে সত্যি করে তুলতে আসুন নতুন প্রজন্মের সাহসী যাত্রায় অংশ নিই। সকল প্রাণের জন্য খাদ্য নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করে তুলি।

happy wheels 2