সৌখিনতা ও জীবনের প্রয়োজনে ঘোড়ার ব্যবহার
চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
মনে কর, যেন বিদেশ ঘুরে/ মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে। তুমি যাচ্ছ পালকীতে, মা, চ’ড়ে/ দরজাদুটো একটুকু ফাঁক করে, আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার পরে/ টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে। রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে/ রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে॥ বিশ^ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বিখ্যাত কবিতা বীর পুরুষ এ ঘোড়া কে ঠিক এভাবে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। এ কবিতায় ডাকাতরা যখন বীর পুরুষ ও তার মাকে আক্রমণ করতে আসছিল, বেয়ারাগুলো যখন পালকি ছেড়ে পাশের কাটা বনে থরো থরো কাঁপছিল এমন সময় বীরপুরুষ ঘোড়া ছুটিয়ে ডাকাতদের মাঝে গিয়ে ভয়ানক লড়াই করে ডাকাতদের মাথা কেটে রক্ত মেখে ঘেমে মায়ের কাছে বীরের বেশে ফিরে আসলে মা পালকি থেকে নেমে বীর পুরুষ খোকাকে চুমু খেয়ে কোলে তুলে নিচ্ছিল। কেবল বীর পুরুষ নয়, এমন অনেক কবিতা, গান ও গল্প সিনেমায় ঘোড়ার ব্যবহার পাঠক দর্শককে আকৃষ্ট করে। আগেকার দিনে যুদ্ধ ক্ষেত্রে ঘোড়ার ব্যাপক ব্যবহার ছিল। সৌখিন ও ধনাঢ্য ব্যক্তিরা সৌখিনতার প্রতীক হিসেবে ঘোড়ায় চড়ে বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াত করতেন। অংশ নিতেন এবং এখনো অনেকে অংশ নেন দেশের বিভিন্ন এলাকার ঘোড়ার বাহাজে। অনেকে আবার পেশা হিসেবে জীবন চালানোর নিমিত্তে ঘোড়া ও ঘোড়ার গাড়ি পরিচালনা করেন।
পাবনার চাটমোহরের কুকড়াগাড়ি গ্রামের মৃত জানা মন্ডলের ছেলে আস্তুল মন্ডল। যতটা না বয়স কঠিন বাস্ততবতার মুখোমুখী হয়ে তার চেয়ে বেশি নুয়ে পরেছেন। শারিরিকভাবে কাজ কর্মে প্রায় অক্ষম হলেও জীবন তো চালাতে হবে। তাই তো সকাল হলেই বেড়িয়ে পরেন ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে। ঘোড়ার গাড়িতে করে মাঠ থেকে কৃষকের বোনা আমন ধান বাড়িতে এনে দেন। কাটেঙ্গার মাঠের মধ্যে ঘোড়া গাড়ি নিয়ে ভাড়ার অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। আলাপকালে আস্তুল মন্ডল বলেন, “পাঁচ বছর হলো ঘোড়ার গাড়ি চালাই। কোন জমা জমি নাই আমার। এমনকি বাড়ির জায়গা ও। রাস্তার পাশে কোন মতে বাড়ি করে আছি। এক মিয়া। বিয়্যা দিছি। এখন বউ ও আমি দুইজন খানে আলা। ১৫ হাজার ট্যাকায় গতবার একটা ঘোড়া কিনছিল্যাম। ঘোড়াডার হাঁপানির টান আছিল। গাড়ি বব্যার পারতো না।” তিনি আরও বলেন, “আমি আর কতদিন বসায়া থুয়্যা খাব্যার দেবো। বাধ্য হয়া শ্যাষ ম্যাষ কিছু দিন আগে ৪ হাজার ট্যাক্যায় বেচ্যা দিছি। বাচ্চাডা বেঁচি নাই। রাখ্যা দিছি।” বলেই পাশে দন্ডয়মান লাল রঙের ঘোড়ার বাচ্চাটি দেখান তিনি। তিনি বলেন, “প্যারালাইসিস হইছিল। বাও হাত বাও পায়ে শক্তি পাই না। এখন আমন ধানের মওসুম আইছে। বাড়িত বস্যাও ভাল লাগেনা। তাই ধানকুন্যা গ্রামের দিলবার এর ছাওয়াল ঘোড়াআলা জয়নালের কাছ থেক্যা এই ঘোড়াডা দাম ধরায়া আনিছি। পঁচিশ হাজার ট্যাকা চাইছে। আগামি চৈত মাসে যহন চলনবিলি রসুন উঠপি তখন রসুন টান্যা জয়নালেক ঘোড়ার দাম দেবো। মাঠে আসি কোনো সময় ভাড়া পাই। কোনো সময় পাই না। দুই এক খেপ পালি কষ্টে শিষ্টে টানি। দু একশ ট্যাকা ভাড়া হয়। বৌ ছুরতি খাতুন বাড়িত বাড়িত ভিক্ষ্যা করে। চাল টাল পায়। এতা দিয়া ওতা দিয়া কোন মতে চল্যা যায়।”
কাটেঙ্গা মাঠে ঘোড়ার গাড়িতে ধান সাজাচ্ছিলেন কাটেঙ্গা বৌবাজার এলাকার মৃত বাহাদুর আলীর ছেলে হাসেন সরদার (৪৫)। আট নয় মাস পূর্বে ভাড়া বহনের জন্য ২০ হাজার টাকায় ঘোড়া ও একটি গাড়ি কিনেছেন তিনি। হাসেন সরদার বলেন, “সখ কর্যা ঘোড়া ও গাড়ি কিনি। গত চৈত মাসে যখন গম খেশারী মশুর রসুন ওঠে তখন ভাড়া বয়্যা ঘোড়া গাড়ির দাম তুল্যা ফালাইছি। তার কিছু দিন পর ওঠে ইরি ধান। ইরি ধান ও বই। ঘোড়ার গাড়িত লস নাই। তেল মবেল কিচ্ছু লাগে না। মাঠের ঘাস খায়।” তিন ছেলে দুই মেয়ের জনক হাসেন সরদারের দুই কাঠা বাড়ির ভিটা ছাড়া মাাঠাল কোন জমি নেই। বড় মেয়ে ও বড় ছেলেকে বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলের পৃথক সংসার। ছেলেরা কৃষি কাজ করে। ছোট মেয়ে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পরে। হাসেন সরদার আরো বলেন, “ছোট মেয়ে, দুই ছেলে, স্ত্রীসহ আমরা পাঁচজন এক অন্নে আছি। পাঁচজনের ভরণ পোষণে অনেক খরচ। মোটা চালই ৪৫ টাকা কেজি। দৈনিক অন্তত তিনশ টেক্যা খরচ। এখন দিন পনেরো ধান টানত্যাছি। পনেরো দিনি পনেরো হাজার টেকার মতো কামাই হবি। ধান কাটা শ্যাষ হলি আর ভাড়া হবি লয়। ছাওয়াল পালের কিছু আয়সহ আমারডা দিয়্যা কোন রকমে দিন পার করি”।
কেবল গাড়ি বহন নয় সৌখিন মানুষেরা সখ করে ঘোড়া পালন করেন। দেশের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে অংশ নেন ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতায়। এমন একজন সৌখিন মানুষ চাটমোহরের গুনাইগাছা ইউনিয়নের চরপাড়া গ্রামের আবু তালেব (৯২)। সাংসারিক প্রয়োজনে উপজেলা সদরসহ বিভিন্ন যায়গায় যেতে এমনকি হাটে বাজারে যেতে ও ঘোড়ার উপর নির্ভরশীল তিনি। কখনো কখনো হাটবাজার করে বাজারের ব্যাগ বস্তা নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যেতে দেখা যায় তাকে। ঘোরা পালন করে আসছেন প্রায় ৮০ বছর যাবত। আবু তালেব বলেন, “আমার দাদা এবং ঘোড়া চালাত। বাবা যখন মৃত্যুবরণ করেন তখন ও আমাদের তিনটি ঘোড়া ছিল। জ্ঞান, বুদ্ধি হবার পর থেকে আমিও ঘোড়া পালন করে আসছি। ঘোড়ায় চড়ে বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াত করি। অংশ নিই বিভিন্ন এলাকার বাহাজে। আগে অনেকেই ঘোড়া চালালেও এখন এলাকায় ঘোড়ার সংখ্যা কম।”