কাইশ্যাবিন্নি ধান জয় করেছে চর
হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ থেকে সত্যরঞ্জন সাহা ও মুক্তার হোসেন
ঋতু বৈচিত্র্যের বাংলাদেশে, আবাদ বৈচিত্র্যতাও চোখে পড়ার মত। কৃষকগণ এলাকাভেদে ভিন্ন ধরনের ফসল চাষ করেন। কৃষকগণ আবাদের মাধ্যমে বীজবৈচিত্র্য সুরক্ষা করেন। বীজবৈচিত্র্য বিনিময়ের মাধ্য জাত/প্রজাতি সংরক্ষণ করেন। এলাকাভেদে আবহাওয়া ও মাটি অনুযায়ী আবাদ হয়। কৃষকগণ চাষাবাদে দূর্যোগ মোকাবেলায় স্থানীয় জাতের বীজে গুরুত্ব দেন বেশি। তাঁরা শাক-সবজি আবাদের পাশাপাশি ধান আবাদে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
কারণ হিসাবে কৃষক সুশিল বিশ্বাস বলেন, ‘কৃষকের ঘরে ধান থাকলে খাবারের চিন্তা থাকেনা। গ্রামে অধিকাংশ পরিবারই ভাত খেয়ে থাকেন। ঘরের চালের ভাত ও মাঠ-ঘাট থেকে কুড়িয়ে পাওয়া বা চাষকৃত শাকসবজি সংগ্রহ করেই পরিবারে খাওয়া চলে। আর বাঙালি খাবার ভাত, পিঠা, পায়েস, খই, মুড়ি, খিচুরি ও চিড়া ইত্যাদি সবইতো চাল থেকে তৈরি হয়। এই সকল খাবার তৈরিতে প্রয়োজন বৈচিত্র্যময় ধান চাষ।’ তিনি জানান, দূর্যোগে আবাদযোগ্য ধান কৃষক চিন্তহীনভাবে আবাদে সফল হতে পারে। দূর্যোগে মোকাবেলায় বিভিন্ন ধরনের ধান চাষ ও ভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি এবং স্বাদ পাওয়া সম্ভব হয়। স্থায়িত্বশীল কৃষি আবাদের মধ্য দিয়েই ধানবৈচিত্র্য রক্ষা ও খাদ্যের আধার নিশ্চিত হয়। আবাদে চাষীদের ও চরবাসীর দূর্যোগ মোকাবেলায় সহায়ক হবে।
বরুন্ডির কৃষক শিশির রায় (৫৫) বলেন, ‘প্রায়োগিক ধান গবেষণা কার্যক্রম কৃষকের আলোর ঘর। কৃষকগণ প্রাকৃতিভাবে তৈরি হওয়া আপন জ্বালা উদ্ভিদ ও প্রায়োগিক ধান গবেষণা থেকে জৈব কৃষি চর্চার শিক্ষা অর্জন করেন। এই শিক্ষা থেকেই কৃষকগণ নিজস্ব জমিতে ধান ও শাক-সবজি চাষে জৈব উপায়ে আবাদ করেন। কৃষকগণ বীজ সংরক্ষণ করে এলাকা উপযোগী ধানবৈচিত্র্য আবাদ করেন। আমন মৌসুমে ধান চাষ কোন বছর হঠাৎ পানি বেশি আবার কোনবছর পানি নাই খরা হয়ে থাকে। ফলে খরা ও হঠাৎ বেশি পানি সহনশীল মোকাবেলায় ধান চাষ কৃষকের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। এ অবস্থায় আমন মৌসুমে কাইশ্যাবিন্নি ধান আমাদের এলাকা জয় করে চর এলাকায় আউশ মৌসুমে আবাদ হচ্ছে। আবাদে ধানবৈচিত্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
অন্যদিকে পাটগ্রামচরের কৃষাণী আজিনা বেগম (৪৮) বলেন, ‘আমাদের স্থানীয় জাতের ধান হিজল দিঘা, মধুশাইল, শিশুমতি, দিঘা, পরাংগি আউশ, কালো আউশের ধান দিয়েই বছর চলে। এই সকল ধানের চাল দিয়েই পিঠা পায়েস ও খই, মুড়ি, চিড়া ভালো হয়। চরের মানুষ স্থানীয় জাতের ধানের চাল দিয়ে কম বেশি সকলেই পিঠা পায়েস তৈরি করে খায়। চরে স্থানীয় জাতের ধানগুলোর সাথে যুক্ত হয়েছে কাইশ্যাবিন্নি ধান। আমাদের চর এলাকায় পলি মাটিতে আলো বাতাসে ও বৃষ্টির পানিতে কাইশ্যাবিন্নি ধান ভালো হওয়ায়, স্থানীয় জাতের ধান বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সকল স্থানীয় জাতের ধান আবাদে সার, বিষ লাগে না বরং আলো বাতাসে ভালো হয়। কৃষকগণ কাইশ্যাবিন্নি ধান চাষ করার জন্য বীজ বিনিময় করছেন।’
হরিহরদিয়ার কৃষক লুৎফর রহমান (৪৫) বলেন, ‘স্থানীয় পরাংগী আউশ ধানের সাথে কাইশ্যাবিন্নি ধান চাষ করে আমরা সফল হয়েছি। কাইশ্যাবিন্নি ধান আগাম ও লম্বা হওয়ায় বর্ষা/বন্যার পানি মোকাবেলা করতে পারে। এই কাইশ্যাবিন্নি ধান সংগ্রহ করেছি বরুন্ডি প্রায়োগিক ধান গবেষণা মানিকগঞ্জ সদর থেকে। চরের কৃষকগণ আউশ মৌসুমে কাইশ্যাবিন্নি ধান চাষ করে সফল হওয়ায় কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারণ হচ্ছে। কাইশ্যাবিন্নি ধান চরের মানুষের মন জয় করেছে। চর এলাকায় আউশ ধান বপন করে বৈশাখ মাসে। বর্ষা মৌসুমে পানি আসার আগে শ্রাবণের প্রথম দিকে আউশ ধান ঘরে তুলি। আর আমন ধান (হিজল দিঘা, দিঘা, ভাউয়াল্যা) জ্যৈষ্ঠ মাসে বপন করলে বর্ষার পানির সাথে পাল্লা দিয়ে বড় হয়। আমন জাত/প্রজাতির ধানগুলো কর্তন করা হয় অগ্রহায়ণে।’
আমন মৌসুমের ধান উঠার সাথে পিঠা পায়েস খাওয়া বাঙালির সংস্কৃতি। স্থানীয় ধান জাতের ভালো গুণ হলো; বেশি পানিতে হয়, কম পানিতে হয়, আবার খরায় ধান হয়। দূর্যোগ মোকাবেলায় সহায়ক ও কৃষকদের ধান চাষে নিরাশ হতে হয় না। ধান চাষে উৎপাদন খরচ নাই, কৃষকের ঘরে আসে নিরাপদ খাদ্য ধান আর গরু-মহিষের জন্য খড়। স্থানীয় জাতের ধান দূর্যোগ মোকাবেলায় ও জাতবৈচিত্র্য সংরক্ষণে সহায়ক হয়।