ব্যাঙের পায়ের দাগে বর্ষার আগমনী বার্তা
বারসিক ফিচার ডেস্ক::
প্রকৃতিতে এমন অনেক প্রাণী আছে যাদের দ্বারা মানবজাতির অনেক কল্যাণ হয়। প্রকৃতির এমনই একটি প্রাণী ব্যাঙ। পরিবেশবাদীরা ব্যাঙকে পরিবেশ ও প্রকৃতি বন্ধু হিসেবে আখ্যায়িত করেন। আবার কবিরা ব্যাঙ ও বর্ষা নিয়ে রচনা করেছেন অনেক কবিতা, গান, গল্প, ছড়া। ব্যাঙ নিয়ে বিজ্ঞানীরা অনেক আবিষ্কার ও ব্যবচ্ছেদ করেছেন। কিন্তু ব্যাঙ যে একটি জনগোষ্ঠীর কৃষি ও অর্থনৈতিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা জুড়ে থাকতে পারে সে ঘটনা হয়তো অনেকের কাছে অজানা। তেমনই এক অজানা তথ্য আমরা রাখাইন জনগোষ্ঠীর জীবন পর্যালোচনা করে পেয়েছি যা তাক লাগিয়ে দেয় সবাইকে।
আদিবাসী রাখাইন জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাঙ একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশ বন্ধু। কারণ তারা ব্যাঙের পায়ের দাগ দেখেই বুঝে নেন বর্ষার আগাম বার্তা। এতে তাদের জন্য সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধার হয়। আদিবাসীরা বিশেষ করে কক্সবাজারের রাখাইন আদিবাসীরা কোন সময়ে কি ফসল চাষ করবেন, কখন জমিতে হাল দিবেন, কখন বীজ তলা করবেন, কি পরিমাণ নাপ্পি মজুদ রাখবেন এবং কোন সময়ে শুটকীর চাহিদা ও বাজার দর বেশী থাকবে সব কিছু ওই ব্যাঙের পায়ের দাগ দেখেই বুঝতে পারেন এবং সিদ্ধান্ত নেন। বিশেষতঃ পাহাড়ী এলাকায় এক জাতীয় কুনো ব্যাঙ দেখা যায়, যার পায়ের নলাতে পর্যায়ক্রমে তিন স্তরবিশিষ্ট বৃত্তাকার অস্পষ্ট দাগ থাকে। প্রথম স্তর জৈষ্ঠের ১৫ থেকে আষাঢ়ের ২৫, দ্বিতীয় স্তর আষাঢ়ের ২৬ থেকে শ্রাবনের ৩০, তৃতীয় স্তর ভাদ্রের ১ থেকে আশ্বিনের ৩০ সময় ধরা হয়।
বর্ষা মৌসুমে বৃত্তগুলো লাল রং ধারণ শুরু হয়। কোন স্তরের বৃত্তটি লাল রং ধারণ করলো তার ওপরই নির্ভর করে বর্ষা সম্পর্কে রাখাইন আদিবাসীদের আগাম ধারণা সৃষ্টি হয়। ব্যাঙ এর পায়ের পাতার প্রথম স্তরের দাগটি গাঢ় লাল হলে তারা ধরেই নেন যে সে বছর বর্ষার প্রথমে ভারী বর্ষণ হবে। আর হয়ও তাই। একইভাবে দ্বিতীয় স্তরে লাল দাগ হলে বর্ষার প্রথমে ছিটেফোটা বৃষ্টি হবে আর মাঝামাঝিতে একেবারে ডুবিয়ে দিবে। তবে তৃতীয় স্তরে লাল দাগ থাকলে সে বছর কৃষকের মাথায় হাত। যেন এক অশনি সংকেত।
ধরে নিচ্ছি এ বছর রাখাইন কৃষকেরা ব্যাঙের পায়ের তৃতীয় স্তরে লাল ব্ত্তৃকার দাগটি দেখেছেন। ফলশ্রুতিতে যা হবার তাই হবে, বৃষ্টির দেখা মিলবে না, তবে ঝরঝরে রোদ্দুর থাকায় আদিবাসীরা নাপ্পি ও শুটকীর মজুদ বারিয়ে দিবে। কারণ তারা ধারণা করছেন শেষ দাগ অনুযায়ী ভারী বর্ষণ নামবে ভাদ্র-আশ্বিনে। আর সে সময়ে বাজারে নাপ্পির দাম থাকে কেজি প্রতি ৩৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা। ভারী বর্ষণে কিছুটা বন্যা ভাব দেখা দিলে বাজারে মাছের তীব্র সংকট দেখা দেয়, তখন আদিবাসীরা কিছু শাক সবজি সংগ্রহ করতে পারলেই নাপ্পি দিয়ে চালিয়ে দিতে পারেন মাসের পর মাস। আর ধান রোপন ও চাষ করতে না পারাতে যে অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে তারা পড়েন তার কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারেন নাপ্পি ও শুটকীর ব্যবসা করে। তাই ব্যাঙ যেমন একাধারে তাদের আগামবার্তা দেয় পাশাপাশি তাদের অর্থনৈতিক জীবন ও আপদকালীন সময়ের দিক নির্দেশনা দিয়ে আদিবাসী জীবনের ঝুঁকির দিকটা অনেকটাই কমিয়ে আনতে সহায়তা করে। আর এ সব কিছুই সম্ভব হয়েছে একটি দীর্ঘ সময়ের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে।
তাই এক কথায় বলা যায় ব্যাঙ নিয়ে আমাদের চিরাচরিত ধারণাকে পাল্টে দেয় এই রাখাইন জনগোষ্ঠীর পর্যবেক্ষণ। এই লোকায়ত ধারণা ও জ্ঞান এ অঞ্চলের মানুষের জীবন ও উন্নয়নে একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এটাই আশা করে স্থানীয় মানুষ ও পরিবেশবিদরা।
(দেওয়ান মোঃ আলী ইমরান এর সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে লেখাটি তৈরী করা হয়েছে )