কুষ্টিয়ার তিলের খাজা, পাহাড়ি জুম তিল ও মেধাস্বত্ত্ব সম্পদের অধিকার
পাভেল পার্থ, লেখক ও গবেষক ::
১৮৫৭ সালে কুমারখালী-খোকসা ও বালিয়াকান্দি নিয়ে গঠিত হয় কুমারখালী মহকুমা। পাবনা জেলার অধীন এই মহকুমা ১৮৭১ সালে বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার অন্তর্ভূক্ত হয়। পদ্মা, গড়াই, কালিগাং, ডাকুয়া নদীর এই কুমারখালী অববাহিকায় লালন শাহ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মীর মশাররফ হোসেন, কাংগাল হরিনাথ, রায়বাহাদুর জলধর সেন, বাঘা যতীন, শীবচন্দ্র বিদ্যার্ণব, ওহাবী নেতা মিয়াজান কাজী, আকবর হোসেন, অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, কৃষক প্রজা আন্দোলনের নেতা মৌলভী শামস উদ্দীন, গোলাম কুদ্দুস, শচীন্দ্রনাথ অধিকারী, বসন্ত কুমার পাল, গগন হরকরা, প্রমথ চৌধুরী, মাসুদ করিমসহ কত না মহাজন তাদের দিন কাটিয়েছেন। তৈরি করেছেন কত না মহান সৃষ্টি। আর এই অববাহিকাতেই তৈরি হয়েছে বাংলার আরেক নিজস্ব খাবার তিলের খাজা।
তিল সাধারনত তেল করে খাওয়া ছাড়াও দেশের নানাপ্রান্তে নানান খাবার উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে নানান ভাবে। তিলের নাড়ু, পিঠার ভেতর তিলের পুর, তিল তক্তী, তিলের মটকা যেমন জনপ্রিয় বাঙালি খাবার। আদিবাসীদের ভেতরও এই তিল ব্যবহৃত হয় নানান ভাবেই। মধুপুরের মান্দিরা একসময় স্নেম(তিল) ফলাতেন জুমতালে আর তা দিয়ে তৈরি হত মান্দি পিঠা বুবুরংতি। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে পাহাড়ে জুম চাষের এক অনন্য ফসল ছিল তিল। পাহাড় এলাকায় নাগাতিলের ভর্তা এখনও এক আকাঙ্খিত খাবার। সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় পৌষ মাসের শেষদিন পালন করা হয় ‘তিল্ল্যা সংক্রান্তি’। ওই দিনে নানান জাতের পিঠা পুলি যাই খাওয়া হোক না কেন তিলের লাড়ু লাগবেই। এই তিল এখন বাংলাদেশের এক বিলুপ্তপ্রায় ফসল। এখন দেশে তিলের সাথে আমাদের পরিচয় ঘটে দু’ভাবে। বড় বেকারী সামগ্রীগুলো রুটি-বিস্কুট এ তিল ছিটিয়ে দেয়া হয়, যা কেবলই ধনী মানুষদের পক্ষে কেনা সম্ভব। আর সাধারণ মানুষের সাথে তিলের চলতি সম্পর্কটি সাধারণত: হয় তিলের খাজার ভেতর দিয়েই। কুষ্টিয়ার তিলের খাজা, যা এখনও আমাদেরকে দেশের এক বৈচিত্র্যময় ফসলের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয় বারবার।
খেজুরের গুড়, বাদাম, নারিকেল, তিল দিয়ে বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার মতই কুষ্টিয়াতেও বাঙালিদের ভেতর তৈরি হত মটকা। কুমারখালীর নারীরাই চলতি সময়ের জনপ্রিয় ও দেশে সর্বাধিক ব্যবহৃত তিলের তৈরি খাবার উপকরণ তিলের খাজা উদ্ভাবন করেছেন। একটা সময় কুষ্টিয়া এলাকায় আখ চাষ হত। আখের চিনি মাটির চুলায় জ্বাল দিয়ে টগবগ করে ফুটানো হয়। খুব উত্তপ্ত চিনির ‘লই’ পরিস্কার শানের উপর একটু ঠান্ডা হওয়ার জন্য ঢেলে দেয়া হয়। তারপর ঐ লই উঠিয়ে একটি হুকে বেঁধে দু’দিকে দু’জনে ধরে টানাটানি করে ভেতর ফাঁপা করা হয়। ফাঁপা অংশকে বারে বারে ভাঁজ করে অনেকগুলো ছিদ্র করা হয়। এরপর পাটির ওপর বিছিয়ে কিছুক্ষণ রেখে দিতে হয় শক্ত হওয়ার জন্য। তারপর মাপমত কেটে বিছিয়ে দেয়া হয় মচমচে তিল ভাজা। সাধারণত: বছরের অন্যান্য সময় বানালেও শীতকালেই তিলের খাজা বেশি বানানো হয়। এক মণ তিলের খাজা বানাতে প্রায় ৫-৬ ঘন্টা লাগে। সাধারণত: রাতের দিকেই খাজা বানানোর কাজটি করা হয়। আগে এই খাজা বাড়ি বাড়ি বানালেও এখন কুষ্টিয়া শহরেই প্রায় তিনটি তিলের খাজার কারখানা আছে।
কুষ্টিয়ার স্টেশন রোডের ভাই ভাই তিলের খাজা’র মালিক আনোয়ার হোসেন মিন্টু জানান, এখানে এত সুগারমিল কিন্তু আমরা চিনির কোনো সুবিধা পাইনা, ভারতীয় চিনি দিয়ে খাজা বানাতে হয়, অথচ আমাদের আখ চাষটাকে গুরুত্ব দিয়ে কারখানাগুলো চালু রাখলে চিনির দাম অনেক কম রাখা সম্ভব। কারখানা থেকে তিলের খাজার ব্যবসা চলে শীতের তিনমাস। প্রতিদিন ভাই ভাই তিলের খাজা কারখানা থেকে প্রায় এক মণ তিলের খাজা বিক্রি হয়। চলতি সময়ে এক কেজি তিলের খাজা কারখানা থেকে ৫২-৫৫ টাকা দরে বিক্রি করা হয়। অবরোধ, হরতাল থাকলে তিলের খাজার বিক্রি কমে যায়। বাজারে চিনির দাম, তিলের দামের উপর খাজার দামও উঠানামা করে।
তিলের খাজার জন্য ব্যবহৃত তিলটি কিন্তু কুষ্টিয়া এলাকায় জন্মায় না। এটি কেবল জন্মে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায়। পাহাড়ি এলাকার এই জুম তিল স্থানীয় এলাকায় প্রেমতিল নামে পরিচিত। কুষ্টিয়ার মহাজনেরা চট্টগ্রাম থেকে এই তিল খরিদ করে নিয়ে আসেন। প্রতি বস্তায় প্রায় ৯০-৯৫ কেজি তিল থাকে। প্রতি কেজি তিল কিনতে হয় ৪০ টাকা হিসেবে। কার্তিক মাসে এই তিল উঠে বলে তখন দামও কিছু কম থাকে। তিলের খাজা ব্যবসায়ী মো. ইলিয়াস হোসেনের মতে কুষ্টিয়াতে প্রতিবছর প্রায় ১০০ বস্তা তিল চট্টগ্রাম থেকে কেনা হয়। স্থানীয় এলাকায় তিল চাষ হলেও জুমতিল ছাড়া খাজা হয় না।
তিলের খাজার সবচে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হল তিল পাইট (তিলের প্রক্রিয়াজাতকরণ) করা। আর এই কাজটি করেন গ্রামের নারীরাই। এখনও পর্যন্ত ছেউড়িয়া গ্রামের নারীরাই তিল পাইটের কাজগুলো সবচে’ ভাল জানেন। বস্তা থেকে প্রেমতিল ঝেড়ে পরিস্কার করে ভিজিয়ে রাখতে হয় তারপর মুগুর দিয়ে পিটিয়ে খোসা উঠানো, খোসাছাড়ানো তিল ঝেড়ে আবার রোদে শুকাতে হয়। তারপর তাওয়ায় তিল মচমচ করে ভাজতে হয়। এভাবে নারীরা এক মণ তিল পাইটের জন্য মজুরী পান সত্তুর টাকা। তিল খাজার কারিগর মঞ্জু বিশ্বাস জানান, কুষ্টিয়ার কারখানাগুলোতে কোনো শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক নেই এখানে সবাই যার যার কাজ করে। বছর শেষে সবাই মুনাফার টাকা সমান ভাগ করে নেয়। কুষ্টিয়ার এই তিলের খাজার সকল উপকরণ, এর উৎপাদন কৌশল, ব্যবহার, পদ্ধতি সবই স্থানীয়ভাবে তৈরি হয়েছে।
পাহাড়ি এলাকার জুমচাষের ফসল আজ কুষ্টিয়ার তিলের খাজার ভেতর দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশে। যদি আমাদেরকে তিলের খাজাও রাখতে হয় তাহলে অবশ্যই আদিবাসীদের জুম চাষের অধিকারকে নিশ্চিত করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে আখচাষের অধিকার। দেশীয় ফসলের মাধ্যমে দেশীয় প্রযুক্তি ও জ্ঞান ব্যবহার করেই দেশীয় কায়দায় গড়ে তুলতে হবে আমাদের যৌথ উন্নয়ন। এখনও দেশের দরিদ্র মানুষেরাই দেশের বৈচিত্র্যময় শস্য ফসলসহ জীবনবান্ধব ধারাগুলোকে টিকিয়ে রেখেছেন।
রাষ্ট্রকে আজ এইসব ধারার দিকে মনোযোগী হতে হবে। বহুজাতিক কোম্পানির একচেটিয়া বাজার দখলের বিরুদ্ধে এখনও দেশের এইসব তিলের খাজার মত উদ্যোগগুলোই জনগণের লড়াইকে সমুন্নত রেখেছে। পাহাড়ের আদিবাসী জুমিয়ারা তিল জুম করেন, সমতলের কৃষকেরা আখ চাষ করেন, কুষ্টিয়ার নারী পুরুষেরা এই তিল আর আখের চিনি দিয়ে খাজা বানান। আমরা খাজা খাওয়ার ভেতর দিয়ে এই প্রতিটি প্রক্রিয়ার সাথেই জড়িত। তাই দেশের উন্নয়নে সম্পর্কিত সকল জায়গার কথাই ভাবতে হবে আমাদের। এর একটি বিপন্ন বা অনিশ্চিত হলেই আর কোনো স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন সম্ভব নয়।
দুনিয়াব্যাপী আজ বহুজাতিক কোম্পানিরা শস্য সম্পদসহ মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি-কৌশল-প্রক্রিয়া হাতিয়ে নিচ্ছে। বহুজাতিক মনসান্টো কোম্পানি ভারতীয় চাপাতি রুটি বানানোর পদ্ধতি প্যাটেন্ট করেছে, এর আগে ভাঁপা ভাত রান্নার পদ্ধতি প্যাটেন্ট হয়েছিল। প্যাটেন্ট হলে বাণিজ্যিকভাবে আর ওই জিনিস কেউ বানাতে পারবে না বা আইনত কোম্পানি যেভাবে প্যাটেন্ট করে সেই নির্দেশই শুনতে হবে। বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ‘ট্রিপস চুক্তি’ স্বাক্ষর করেছে। সর্বনাশা ওই চুক্তির ২৭.৩ (খ) ধারা মতে জনগণের সম্পদ ও কোনো পদ্ধতি জ্ঞান প্যাটেন্ট করার অধিকার রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ আন্তজার্তিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদ(সিবিডি-১৯৯২) স্বাক্ষর ও অনুমোদন করেছে, যেখানে স্থানীয় সম্পদ ও জ্ঞান পদ্ধতিকে জনগোষ্ঠীর নিজেদের অধিকারে রাখার পক্ষে বেশকিছু পরামর্শ আছে। বাংলাদেশকে এখনই সতর্ক হতে হবে। দেশের জনগণের প্রাণবৈচিত্র্য-জ্ঞান-পদ্ধতি-বুদ্ধিসহ সকল সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রকে জনগণের পক্ষে আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে
কুষ্টিয়ার তিলের খাজার উপর মেধাস্বত্ত্ব অধিকার স্থানীয় মানুষদের। কোনো বহুজাতিক কোম্পানি জীবনমান উন্নয়ন আর শিল্পায়নের নামে জনগণের মেধাস্বত্ত্ব অধিকার বিপন্ন করে তিলের খাজার প্যাটেন্ট করে তিলের খাজার বহুজাতিক একচেটিয়া ব্যবসা করবে তা কখনোই জনগণ মেনে নেবে না। পদ্মা, গড়াই, কালিগাং, ডাকুয়া নদীর অববাহিকায় তিলের খাজায় খাজায় এখনও সেই হার না মানা ছড়িয়ে আছে আপন কায়দায়।
রচনাকাল: ২০০৭, কুষ্টিয়া