কৃষি ও সংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষায় বরেন্দ্র বীজ ব্যাংক
বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে শহিদুল ইসলাম
বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্য এবং সংস্কৃতিক বৈচিত্র্য যখন কমে যাচ্ছে, বৈচিত্র্য বিমুখ মানুষের সাথে মানুষের, প্রাণপ্রকৃতির সম্পর্ক যখন সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে এবং দিনে দিনে যখন কমে যাচ্ছে একে অপরের সাথে আন্তঃসম্পর্কগুলো ঠিক তখনই বরেন্দ্র বীজ ব্যাংক মানুষ, প্রাণ ও প্রকৃতির মধ্যকার সম্পর্ক ও বিশ্বাস স্থাপনে পালন করেছে উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা! এই বীজ ব্যাংককে কেন্দ্র করেই কৃষি ও কৃষি সংস্কৃতিগুলো আবারও নতুনভাবে জেগে ওঠে, কৃষকদের মধ্যে পুনঃজীবিত হয় আদান-প্রদান ও আন্তরিক মিথষ্ক্রিয়ার।
বিশেষ বৈচিত্র্য আর আলাদা ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যমন্ডিত বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বরেন্দ্র অঞ্চল খ্যাত রাজশাহীর তানোর উপজেলার পাঁচন্দর ইউনিয়নে দুবইল গ্রামে বরেন্দ্র বীজ ব্যাংকটি অনুষ্ঠিত। এটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠায় পায় ২০১৫। যার হাত ধরে এই বরেন্দ্র বীজ ব্যাংকের যাত্রা হয় তিনি হলেন লুপ্তধানের রক্ষক ও ২০১৩ সালে জাতীয় পরিবেশ পদকপ্রাপ্ত কৃষক মোঃ ইউসুফ আলী মোল্লা। এই বীজ ব্যাংক এর মাধ্যমে ইউসুফ মোল্লা ২০১০ সাল থেকে বরেন্দ্র অঞ্চলসহ সারা বাংলাদেশের কৃষকদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছেন! এই বরেন্দ্র বীজ ব্যাংকটিকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে কৃষকের মধ্যকার সম্পর্কের আস্থা, গঠিত হয়েছে সাংগঠনিক ভিত। একইসাথে ধানসহ শস্য ফসলের বৈচিত্র্য সুরক্ষায় অবদান রাখছে বরেন্দ্র বীজ ব্যাংক।
দিনে দিনে বিভিন্ন সংগঠন এবং আগ্রহী মানুষগুলোর যৌথ সমন্বয়ে বরেন্দ্র বীজ ব্যাংক এর যোগাযোগের সীমানা বেড়েছে। এই বীজ ব্যাংক-এর মাধ্যমে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষি ও সংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সুরক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করছেন। প্রতিবছর এই বরেন্দ্র বীজ ব্যাংকের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় নবান্ন উৎসব, পৌষপার্বণসহ প্রাণপ্রকৃতির মেলা। এই অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে নানা প্রান্ত থেকে নারী ও পুরুষ কৃষকগণ বীজ ও কৃষির নানা উপকরণ বিনিময় করেন।
বরেন্দ্র বীজ ব্যাংকে রয়েছে উক্ত অঞ্চলের উপযোগী প্রায় ২০০ জাতের ধান, ৩০ জাতের সবজি, ২৫ জাতের রবি শস্যের বীজ। বীজ ব্যাংককে কেন্দ্র করে কৃষকগণ বীজ বিনিময় করছেন। এ প্রসঙ্গে তানোর উপজেলা কৃষি অফিসার মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, “বরেন্দ্র বীজ ব্যাংক স্থানীয় প্রজাতির শস্য-ফসল সংরক্ষণে একটা বড় ভূমিকা পালন করছে। এই স্থানীয় প্রজাতিগুলো রোগ পোকা, দুর্যাগ সহনশীল। একই সাথে আমাদের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত দিক থেকেও সম্পর্কিত।” তিনি আরো বলেন, “বরেন্দ্র অঞ্চল উপযোগী শস্য বহুমূখীকরণে বরেন্দ্র বীজ ব্যাংক একটা বড় ভূমিকা পালন করছেন। বারসিকসহ সরকারের উপজেলা কৃষি বিভাগ বরেন্দ্র বীজ ব্যাংককে সার্বিক সহযোগিতা করায় তাদের কাজগুলো উত্তোরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।”
বরেন্দ্র অঞ্চলের নানা প্রান্তের কৃষকদের সাথে সম্পর্ক ছাড়াও ‘বরেন্দ্র বীজ ব্যাংক’ এর মাধ্যমে উক্ত অঞ্চলের কৃষকরা বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার কৃষকদের সাথেও কৃষিকেন্দ্রিক সম্পর্ক তৈরি করেছেন। বরেন্দ্র বীজ ব্যাংক-এর সভাপতি ইফসুফ মোল্লা জানান, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ছাড়া দিনাজপুর, বগুড়া নীলফামারী, নোয়াখালি, ঝিনাইদহ, নেত্রকোনা, সাতক্ষিরা, কুমিল্লার কৃষকদের সাথে বিভিন্ন সময় বীজ বিনিময় করা হয়ে থাকে। তাদের সাথে একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। বীজ ব্যাংকটিকে কেন্দ্র করে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ ও সেবা গ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। স্থানীয় কৃষকগণ তাদের নানা ধরনের সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান পাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে তানোর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ইমরান আলী মোল্লা বলেন, “বরেন্দ্র বীজ ব্যাংটির সদস্যরা ইউনিয়নসহ উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে যোগাযোগ করেন, আমাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করে বলেই তাদের সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান হয়।”