নদীর সাথে আমাদের একটা গভীর আত্মীয়তার সম্পর্ক- দেবেন্দ্র নাথ মন্ডল
৮৫ বছর বয়সী দেবেন্দ্র নাথ মন্ডল। বাড়ি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবন এবং নদী সংলগ্ন পদ্মপুকুর ইউনিয়নের কামালকাটি। এলাকাটি প্রাকৃতিক দূর্যোগপ্রবণ হওয়ায় দুর্যোগের সাথে দেবেন্দ্র মন্ডল এর নিত্য উঠাবসা। খুব কাছ থেকে দেখেছেন অনেকগুলো বড় বড় প্রলয়ঙ্করী প্রাকৃতিক দূর্যোগ। পাশাপাশি, জলবায়ু পরিবর্তন অধ্যয়ন এর এক জীবন্ত পাঠশালা তিনি। এলাকার ভৌগলিক বিষয়ে রয়েছে জীবনঘনিষ্ঠ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা। জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে চলমান উন্নয়ন রাজনীতি এবং পরিকল্পনাকে ঘিরে রয়েছে নিজস্ব ব্যাখ্যা। নদী, জল আর বন এই প্রাকৃতিক সম্পদ এর সাথে দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের টানাপোড়েন এর গল্প করেছেন বারসিক নিউজ এর প্রতিনিধি’র সাথে। তাঁর সাথে কথোপকথনের চুম্বক অংশগুলো পাঠ উপযোগী করে তুলে ধরেছেন শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে মফিজুর রহমান।
বারসিক নিউজ : কেমন আছেন?
দেবেন্দ্র নাথ মন্ডল : ভালো আছি।
বারসিক নিউজ : আপনি কতদিন হলো এই এলাকায় বসবাস করছেন ?
দেবেন্দ্র নাথ মন্ডল : ৮৫ বছর এই এলাকায় বসবাস করছি।
বারসিক নিউজ : নদীর সাথে আপনাদের সর্ম্পক একটু ব্যখ্যা করবেন?
দেবেন্দ্র নাথ মন্ডল : নদী আমাদের উপর আড়ি নিয়ে বসেছে। নদীর একুল ভাঙছে আর ও কুল গড়ছে। নদীও বারে বারে ভাঙছে আর আমরাও ঘর বাড়ি সরিয়ে অন্য স্থানে তৈরি করছি। আসলে নদীর সাথে আমাদের একটা গভীর আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। যার কারণে নদী ভাঙলেও আমরা অন্য স্থানে চলে যেতে পারছি না।
বারসিক নিউজ : আপনার পর্যবেক্ষণে ছোটবেলার খোলপেটুয়া নদী আর বর্তমানের খোলপেটুয়া নদী সম্পর্কে বলুন।
দেবেন্দ্র নাথ মন্ডল : আগে খোলপেটুয়া নদী এতো বড় ছিল না। তবে বর্তমানে খোলপেটুয়া ভেঙে অনেক বড় হয়ে গেছে। আগে নদীতে ভাঙন কম ছিল। কিন্তু বর্তমানে নদীতে ভাঙন বেশি দেখা দিচ্ছে।
বারসিক নিউজ : নদী ভাঙন কেন হয় বলে আপনারা মনে করেন
দেবেন্দ্র নাথ মন্ডল : নদী ভাঙনটা এক পাড়ে চর পড়ে আর অন্য পাড়ে যদি স্রোত বয় তাহলে স্রোতের গতিতে পাড়ের নীচের মাটি গর্ত হয়ে যায়। যার ফলে বাঁধ ভেঙে নদীতে চলে যায়। পানির ¯্রােতের কারণে নদী ভাঙন দেখা দেয়।
বারসিক নিউজ : খেলপেটুয়া নদীতে কখন বাঁধ দেওয়া হয়েছিল? বাঁধের বর্তমান অবস্থা কি ?
দেবেন্দ্র নাথ মন্ডল : ১৯৬৭ সালে নদীতে প্রথম বাঁধ দেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে বাঁধের অবস্থা খুব খারাপ। ভাঙনের ফলে রাস্তা নদীর ভিতর চলে যাচ্ছে। এই ওয়াপদা আগে ২০/২৫ হাত চওড়া ছিল। ভাঙতে ভাঙতে এখন ২/৩ হাত আছে। কামালকাটি গ্রামের ভেঁড়ি বাঁধ যে কোন সময় ভেঙে যেতে পারে।
বারসিক নিউজ : কোন দুর্যোগ হলে পরবর্তী সময়ে সবাই যে ত্রাণ বিতরণ করে এই সম্পর্কে আপনার মতামত কি?
দেবেন্দ্র নাথ মন্ডল : আমরা ত্রান চাই না, ওয়াপদা রাস্তা ভালোভাবে সংস্কার চাই।
বারসিক নিউজ : খেলপেটুয়া নদীর ভাঙনের ইতিহাস একটু বলবেন?
দেবেন্দ্র নাথ মন্ডল : ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট প্রথম নদী ভাঙন হয়। তারপর ১৯৭৭ সালে দ্বিতীয়বার নদী ভাঙন হয় এবং ২০০২ সালে তৃতীয়বার নদী ভাঙনের ফলে তিনবার বাড়ি সরিয়ে অন্য স্থানে বসত ঘর তৈরি করতে হয়।
বারসিক নিউজ : নদী ভাঙনের ফলে আপনার পরিবারসহ অত্র এলাকার বিভিন্ন সময় যে ক্ষতি হয়েছে সে গল্প আমাদের বলবেন?
দেবেন্দ্র নাথ মন্ডল : প্রথম ভাঙনের সময় আমার বয়স ছিল ১৬ বছর। যৌথ পরিবার হওয়ায় পরিবারের লোক সংখ্যা ছিল ২০ জন। মোট ঘর ছিল ৫টি; তার মধ্যে ৪টিতে বসবাস করা হত এবং একটিতে রান্না করা হত। দ্বিতীয়বার ভাঙনের সময় আমার বয়স ছিল ৪৬ বছর, পরিবারের লোক সংখ্যা ছিল ৩০ জন। বসত ঘর ছিল ৫টি, রান্না ঘর একটি এবং বৈঠক ঘর ছিল একটি। তৃতীয়বার ভাঙনের সময় আমার বয়স ছিল ৭১ বছর। তখন পরিবারের লোক সংখ্যা ছিল ১০ জন। বর্তমানে যেখানে বসত বাড়িটি আছে সেটি ও ভাঙনের ঝুঁকিতে আছে। তিনবার নদী ভাঙনের ফলে ৫ শত বিঘা জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। আমার মত অনেকের জায়গা জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়াই কামালকাটি গ্রামের ২০টি পরিবারের কোন জায়গা জমি না থাকায় ভারতে চলে গেছে।
বারসিক নিউজ :নদী ভাঙনের ফলশ্রুতিতে কৃষিসহ পরিবারের আর্থিক যেসব ক্ষতি হয়েছিল তার সেই দুুঃখ-গাথা আপনার কাছে থেকে শুনতে চাই।
দেবেন্দ্র নাথ মন্ডল : নদী ভাঙনের ফলে কৃষি জমি নষ্ট করে পুনরায় ঘর তৈরি করতে হয়েছে। নতুন করে ঘর তৈরি করতে গিয়ে পরিবারের অনেক সম্পদ বিক্রি করতে হয়েছে।
বারসিক নিউজ : কর্তৃপক্ষ যেভাবে বাঁধ তৈরি করে তার সম্পর্কে আপনার অভিমত কি ?
দেবেন্দ্র নাথ মন্ডল : সরকারিভাবে ভেড়ি-বাঁধ সংস্কারে বিভিন্ন সময় কাজ হয়। কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ অপরিকল্পিত। কারণ নদীর চরের মাটি কেটে বাঁধ উঁচু দেখানো হয়। আমাদের অভিজ্ঞতায় মনে করি, প্রথমে জিআই বস্তায় বালু ভর্তি করে ব্লক ফেলে কাজটি করলে ¯্রােতের গতি কিছুটা কমবে ও পলি পড়বে। সরকারি লোকজন আমাদের কোন কথা না শুনে তাদের মতো করে ভেড়ি বাঁধ সংস্কার করেন। আমাদের পরিকল্পনা মতো কাজটি করলে বাঁধ মজবুত হবে ও সরকারি অর্থ অপচয় হবে না। আমাদের গ্রামের (কামালকাটি) ভেড়ি-বাঁধ যে কোন সময় ভেঙে যেতে পারে। অতি দ্রুত ভেড়ি-বাঁধ সংস্কার করা না হলে যে কোন সময় ভেঙে আবারও আইলার মত অবস্থা হতে পারে।
বারসিক নিউজ : আপনার কাছে দুর্যোগ মানে কি ?
দেবেন্দ্র নাথ মন্ডল : হঠাৎ ঝড়-বৃষ্টি হলে সেটাকে আমরা দুর্যোগ মনে করি।
বারসিক নিউজ : বর্তমান সময় পর্যন্ত আপনি কতগুলো দুর্যোগের স্বাক্ষী? সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগ কোনটি বলে আপনার কাছে মনে হয়েছে? কেন মনে হয়েছে?
দেবেন্দ্র নাথ মন্ডল : ৪টি (১৯৫৭, ৭৮, ৮৮, ২০০৯)। সবচেয়ে ভয়াবহ দূর্যোগ ২০০৯ সালের আইলা। নদীর বান (ঢেউ) রাস্তার উপর দিয়ে পার হয়ে এসেছে। ঝড় এবং বান এক সাথে হওয়ায় মানুষের মাঝে বেশি আতঙ্ক ছড়িয়েছে। পানির ¯্রােতের বেগে ঘর-বাড়ি সব ভেঙে চলে যায়।
বারসিক নিউজ : আইলায় দ্বীপ ইউনিয়ন পদ্মপুকুরের ক্ষয়-ক্ষতি কেমন হয়েছিল ?
দেবেন্দ্র নাথ মন্ডল : ২৪ হাজার বিঘা চিংড়ী ঘের তলিয়ে যায় এবং হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়। পদ্মপুকুর ইউনিয়নব্যাপী তিন বছর ধরে জোয়ার ভাটা চলতে থাকে। যার কারণে আয়ের কোন উৎস্য এখানকার মানুষের মাঝে ছিল না।
বারসিক নিউজ: আপনাকে ধন্যবাদ
দেবেন্দ্রনাথ: আপনাকেও ধন্যবাদ।