“তারপরও আমি সুখি”- নূর সাঈদ
দেবদাস মজুমদার, বিশেষ প্রতিনিধি, উপকূলীয় অঞ্চল
কৃষক বাবার চাষাবাদে সহযোগিতা করতে গিয়ে শিশু বয়সেই নূর সাইদ হিনু কৃষক হয়ে ওঠেন। স্কুলের চৌকাঠে পা রাখতে পারেন নি। কৃষক বাবার অন্য তিন সন্তান লেখাপড়া করে চাকুরী করলেও নূর সাইদের জীবনে তা ঘটেনি। নিজের নাম দস্তখত কোন মতে করতে পারলেও কৃষির পাঠ ভালই রপ্ত করেছেন তিনি। ষাটোর্ধ বয়সী নূর সাইদ জীবনভর কৃষির সাথে জড়িয়ে আজ হয়ে উঠেছেন সফল কৃষক। পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার টিকিকাটা ইউনিয়নের দক্ষিণ ভেচকী গ্রামের কৃষক নূর সাইদ পরিকল্পিতভাবে নার্সারি আর সবজি আবাদে দারিদ্র্যকে জয় করে এখন স্বাবলম্বী। আর তাকে অনুসরণ করে এলাকায় পরিকল্পিত নার্সারী গড়ে উঠছে। যা সবুজ উপকূলে পরিবেশ সুরক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রেখে চলছে।
স্ব-শিক্ষিত কৃষক নূর সাইদ উপকূলীয় অঞ্চল পিরোজপুরের সফল কৃষি ও সফল কৃষকের দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছেন। কৃষিতে লোকায়ত জ্ঞান আর নানান প্রশিক্ষণ কাজে লাগিয়ে ফলদ, বনজ ও ফুলের নার্সারি স্থাপন করে তিনি দারিদ্র্যকে জয় করেছেন। কেবল নার্সারী নয়; সেই সাথে জমির নিবিড় ব্যবহার করে তিনি আপদকালীন মৌসুমী সবজি আবাদ করে এখন লাখপতি কৃষক। একজন সফল কৃষক হিসেবে তিনি টানা তিনবার কৃষি বিভাগের উপজেলা পর্যায়ের পুরস্কারও জিতে নিয়েছেন।
কৃষক নূর সাইদ জানান, তিনি দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান। বাবা মৃত অজেদ আলী আজন্ম নার্সারি আর সবজি আবাদ করেই জীবিকা নির্বাহ করেছেন। চার ছেলের মধ্যে নূর সাইদ সেজ সন্তান। অন্য তিন ভাই স্কুল কলেজে লেখাপড়ার সুযোগ পেলেও কেবল নূর সাইদ স্কুলের বারান্দাও ডিঙাতে পারেন নি। তাকে সাত বছর বয়স থেকেই কৃষক বাবার সাথে কৃষি কাজে সহায়তা করতে হতো। তিনি এখন কেবল নিজের নাম দস্তখত কোন মতে লিখতে পারলেও মঠবাড়িয়া উপকূলে তিনি সফল কৃষকের দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছেন। শুধু তাই নয় তাকে অনুসরণ করে এলাকার বহু কৃষক নার্সারি স্থাপন করে আর্থিক লাভবান হচ্ছেন। তাকে অনুসরণ ও পরামর্শ নিয়ে ভেচকী গ্রামের কৃষক দেলোয়ার হোসেন, দধিভাঙা গ্রামের ফুল মিয়া হাওলাদার, মিঠাখালী গ্রামের চিত্ত মজুমদার, কালা বাওয়ালী, রব হাজি নার্সারি ও আবাদ সম্প্রসারণ ঘটিয়েছেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে যে, কৃষক নূর সাইদ বসতবাড়ির আশপাশ জুড়ে পতিত জমি প্রস্তুত করে মোট আট একর জমিতে পরিকল্পিত নার্সারি স্থাপন করেছেন। এর মধ্যে বনজ, ফলদ, ঔষধি আর ফুলের চারার আবাদ চার একর আর মৌসুমী সবজি করলা, সীম, শসা, বরবটি, চিচিঙা, বেগুন আর নানা জাতের শাকের আবাদ রয়েছে আরও চার একর জমিতে। নার্সারিতে তিনি মাল্টাসহ নানা জাতের ফলদ চারা উৎপাদন করছেন। তিনি কৃষি বিভাগ থেকে নার্সারীর ওপর বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণ আর নিজস্ব ধ্যান ধারণার সমন্বয় ঘটিয়ে গ্রেফটিং কলম পদ্ধতিতে এ নার্সারি গড়ে তুলেছেন। এছাড়া তিনি পিরোজপুরের জেলার স্বরূপকাঠির আকলম গ্রামে একটি মাল্টা চারার নার্সারি স্থাপন করেছেন। সেখানে ৩৫ হাজার মাল্টার চারা গ্রাফটিং কলম পদ্ধতিতে তিনি উৎপাদন করেছেন।
নূর সাইদের আট একর কৃষি প্লটের কিছু জমি নিজের আর বাকী জমি বন্ধকী নিয়ে কঠোর পরিশ্রমে এ নার্সারি ও কৃষি প্রকল্প গড়ে তুলে এলাকায় সফল কৃষকের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সারা উপকূল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে তার নার্সারির চারা। বছরে তিনি ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা আয় করছেন। সেই সাথে তিনি তার নার্সারির কাজে কয়েকজন কৃষি শ্রমিককে কর্মসংস্থানও করতে পেরেছেন। কৃষক নূর সাইদ দুই মেয়েকে লেখাপড়া করিয়ে পাত্রস্থ করেছেন। তবে একমাত্র ছেলে ইসমাইল হোসেন সপ্তম শ্রেণীতে লেখা পড়ার পাঠ চুকিয়ে বাবার নার্সারীর কাজে যুক্ত হয়েছেন। যেমন করে তার বাবা নূর সাইদকে তা করতে হয়েছে।
কৃষক নূর সাইদ জানান, “সংসার থেকে ২৫ বছর আগে তাকে আলাদা করে দেওয়া হয়। লেখা পড়া শিখতে না পারায় তিনি চরম বিপাকে পড়েন। পৈত্রিকভাবে কিছু জমি তিন পান। বাবার সাথে কৃষি কাজ করতে করতে কৃষির প্রাথমিক বিষয়গুলো ভালোই রপ্ত করেন। প্রথমে ৫০০ টাকা দিয়ে বাড়ির কাছে অল্প কিছু পতিত জমি প্রস্তুত করেন তিনি। বহু কষ্টে একটি বেসরকারী এনজিও থেকে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ছোট পরিসরে একটি নার্সারী গড়ে তোলেন। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরতে হয় নি। কৃষি এগিয়েছে তার হাত ধরে আর তিনি এগিয়েছেন স্বাবলম্বনের দিকে। এখন আট একর জমি জুড়ে তার নার্সারি প্লট। বাৎসরিক গড় আয় ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা।
মঠবাড়িয়া উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ৩০০ প্রজাতির নানা ফলদ, বনজ, ঔষধি ও ফুলের চারার আবাদ করে সফল কৃষকের পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ২০০৩-২০০৫ পর পর তিন বছর তিনি কৃষি বিভাগ থেকে উপকূলের সেরা নার্সারী কৃষকের পুরস্কার লাভ করেন।
এ বিষয়ে টিটিকাটা ইউনিয়নর কৃষি ব্লকের উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা কামরুন্নাহার বেগম বলেন, “নূর সাইদ শুধু সফল কৃষকই নন। তিনি এখন কৃষকেরও প্রশিক্ষক। তাকে অনুসরণ করে অনেকেই নার্সারির সাথে সবজি আবাদ করে সফল হয়েছেন।”
মঠবাড়িয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, “নূর সাইদ আসলে কঠোর পরিশ্রমী এক কৃষিপ্রাণ মানুষ। কৃষি নিমগ্ন এই মানুষের কৃষি ছাড়া অন্য কোন জীবন নেই। তিনি মূলত আজন্ম কৃষির সাথে সখ্য হয়ে লড়াই করে এখানে উঠে এসেছেন। কৃষি বিভাগ এমন সফল কৃষককে সব সময় শুধু পরামর্শ নয় সম্মান জানায়।”
সফল কৃষক নূর সাইদ বলেন, সেচ সংকট নিয়ে আজও চাষাবাদে লড়ছি। গ্রামে বিদ্যুৎ নাই। এখনও সদরে যেতে মাটির রাস্তা। কৃষি পণ্য পরিবহন করি নৌকা আর মাথায় নিয়ে। বর্ষায় দূর্ভোগ আরও কষ্ট বাড়িয়ে দেয়। তারপরও আমি সুখি। নার্সারির প্রতিটি চারা আমি সন্তানের মত লালন করি। আমার সুখ আমার আবাদের চারাগাছ সারা উপকূল জুড়ে বেড়ে উঠছে। এসব গাছ মানুষকে খাদ্য, ছাঁয়া আর অর্থের জোগান দিচ্ছে। একজন কৃষকের এর চেয়ে সুখ আর আনন্দের আর কি হতে পারে।