শৈত্যপ্রবাহ ও ঘনকুয়াশায় কৃষকের ফসল সুরক্ষায় এখনো অন্যতম হাতিয়ার লোকায়ত কৃষিজ্ঞান

বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে শহিদুল ইসলাম

ভূমিকা
শীতের মৌসুমে শীত কৃষকের জন্য আর্শীবাদস্বরূপ। শীতকালে শীত হওয়াই স্বাভাবিক। শীতের মৌসুমে শীতকালিন শস্যফসলের রূপ ঝরে শীতের ছোঁয়ায়। শীতকালিন ফসলের পরিমিত শীতের আবেশে ফসলের উন্নয়ন হয়, ফলন বাড়ে। কিন্তু তাপমাত্রার অস্বাভাবিক উঠানামার কারণে ফসল চাষে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষক। চলতি মৌসুমে (২০২২) রাজশাহীতে শীতের প্রকোপ অস্বাভাবিক হবার কারণে শীতকালিন শাকসবজিসহ রবিশস্যের ক্ষতির শিকার হচ্ছে বলে মনে করছেন কৃষকরা। বিগত দুই সপ্তাহ থেকে একটানা শীতের তীব্রতা, ঘনকুয়াশা, শৈত্যপ্রবাহ জনজীবনে যেমন সমস্যা তৈরি করছে তেমনি শস্য ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের জ্যৈষ্ঠ পর্যবেক্ষণ আব্দুস সালাম জানান, বিগত এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়িাস তাপমাত্রা কমে গেছে। গতকাল রবিবার রাজশাহীর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৮ দশমিক ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। তিনি আরো বলেন, ‘এটি চলতি মৌসুমে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা।


রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, চলতি বছরের শীত শূরু হয়েছে ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা দিয়ে। গত ২ জানুয়ারি ২০২৩ ছিলো ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ৩ জানুয়ারি ১৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ৪ জানুয়ারি ১০ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ৫ জানুয়ারি ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ৬ জানুয়ারি ১০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ৭ জানুয়ারি ৯ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাজশাহীর উপর দিয়ে বর্তমান শৈত্যপ্রবাহ চলছে, এটি সপ্তাহজুড়েই থাকতে পারে বলেও জানান।

তীব্র ঠান্ডা, ঘনকুয়াশা ও শেত্যপ্রবাহে ফসলের ক্ষতি
একটানা কয়েকদিন রাজশাহীতে চলমান শৈত্যপ্রবাহ, ঘনকুয়াশার কারণে শীতকালিন শাকসবজি ও রবিশস্যের ক্ষতি হচ্ছে। শীতের তীব্রতা থেকে ফসল রক্ষা করতে গুণতে হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ। কেউ শীত কুয়াশার কারণে পচনসহ অন্যান্য রোগ ঠেকাতে যাচ্ছেতাই অতিরিক্ত কীটনাশক প্রয়োগ করছেন, যার ফলে আর্থিকভাবে যেমন অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে, তেমিন এলাকার পরিবেশ জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হচ্ছে। তীব্র শীত ঘনকুয়াশার কারণে বোরো ধানের বীজতলা নষ্ট হচ্ছে। ফুলকপি এবং ফুলজাতীয় সবজিতে পচনরোগ দেখা দিচ্ছে। অন্যদিকে পরিপক্ক হবার আগেই ঝরে পড়ছে সরিষার ফুল। মসুর, পেয়াজ ও অন্যান্য ডাল জাতীয় গোড়া পচন দেখা দিচ্ছে। একই সাথে পোকার আক্রমণ বেড়েছে। বড়গাছি গ্রামের রবিশস্য চাষী জারসেদ মিয়া(৪৫) বলেন, ‘আমার একবিঘা মসুর গাছে কোথাও কোথাও লাল হয়ে গাছ মারা যাচ্ছে। তিনি মনে করেন- অনেকক্ষনব্যাপী ঘনকুয়াশা আর ঠান্ডা থাকার কারণে মসুর গাছের গোড়াতে পচন হচ্ছে। শিকড় নষ্ট হচ্ছে, আবার গাছ লাল লাল হয়ে যাচ্ছে। মাধবপুর গ্রামের কপি চাষী পিয়ারু ইসলাম (৪৮) বলেন, ‘১৬ কাঠা জমিতে এবার ফুলকপি করেছি, কিন্তু ঘনকুয়াশার কারণে কপির গাছের গোড়া পচে মরে যাচ্ছে, এ ছাড়া পোকার আক্রমণ বেড়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘এগুলো রোধ করতে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করতে হচ্ছে, যার ফলে আর্থিক খরচ আরো বেড়েছে। কিন্তু ফলাফলও তেমন পাওয়া যায়না।’ আলু চাষি রবিউল বলেন, “ যতো শীত হবে ততো আলুর ফলন ভালো হবে, কিন্তু ঘনকুয়াশা আর রোদ না থাকায় আলুর গাছের গোড়া পচে যায় এবং পাতা কুকড়ে যায়।” তিনি মনে করেন এর ফলে বেশি পচন রোগ হচ্ছে। আবার জাব পোকার দেখা দিচ্ছে।


রাজশাহীতে সবজি ব্যাংক ব্যাংক হিসেবে পরিচিত পবা উপজেলার বড়গাছিতে প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি উৎপাদন করেন। শীতকালে আলু, টমেটো, শিম, বাঁধাকপি, ফুলকপি, বেগুনসহ নানা জাতের সবজি চাষ করেন। চলমান তীব্র শীত ও ঘনকুয়াশা থেকে এসকল শস্য ফসল রক্ষা করতে বেশিরভাগে কৃষকই এখন রাসায়নিক কীটনশকের উপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। যার ফলে কৃষকের উৎপাদন খরচ বাড়ার সম্ভাবনা আরো বেশি।

চলমান তীব্র ঠান্ডা ঘনকুয়াশা ও শৈত্যপ্রবাহ থেকে ফসল বাঁচাতে কৃষকের উদ্যোগগুলো
চলমান শৈত্যপ্রবাহ ও তীব্র ঠান্ডায় স্থানীয় কৃষক তাঁর ফসল বাঁচাতে অন্যান্য প্রযুক্তিগত দিকগুলোর পাশাপাশি চিরাচরিত ও লোকায়ত অভিজ্ঞতা নির্ভর চর্চাগুলো কাজে লাগিয়ে ভালো ফলাফল পাচ্ছেন। রড়গাছি কৃষক ঐক্যেও সাধারষ সম্পাদক রায়হান কবির জুয়েল (৪৪) বলেন, ‘আমি ১২ কাঠা জমিতে আলু লাগিয়েছি। শুরুতে জৈবসার, ভার্মিকম্পোস্ট দিয়েছি। এরপর আরেকবার আলুর গাছ বড় হলে একইভাবে জৈবসার আলুর গাছের গোড়ায় দিয়েছি। এর ফলে আলুর গাছ অনেক সবল পুষ্ট হযেছে।” তিনি আরো বলেন, ‘আশপাশের আলুর জমিতে ছত্রাক লাগলে বা পচন রোগ দেখা দিলেও আমার গাছে এখন পর্যন্ত কোন রোগবালাই নেই। আলুর গাছও ভালো আছে।’ তিনি বেশি ফলনের প্রত্যাশাও করেন। তিনি মনে করেন জৈবসার দিয়ে ফসল উৎপাদন করলে রোগবালাই কম হয়, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় ফসল টিকে থাকে।
বোরো মৌসুমের বীজতলা রক্ষায় মাধবপুর গ্রামের কৃষক জামাল উদ্দিন(৩৯) বলেন, ‘যখন ঘন কুয়াশা হয় বিকালে সন্ধ্যার দিকে বীজতলা পাতলা পলিথিন দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। সকালে হালকা রোদ হলে খুলে দেয়া হয়। এবং সারাদিন রোদ না উঠলে ঘন কুয়াশা হলে তা ঢেকেই রাখা হয়। আবার সকালে পানি দেয়া হয় কয়েক ইঞ্চি পরিমাণ, তা আবার বেড় করে দেয়া হয় বিকালের দিকে। এভাবে বীজতলা রক্ষার চেষ্টা করছেন বলে জানান। একই সাথে তিনি ছাই ছিটিয়ে দেন।


কাড়িগড় পাড়ার কুলসুম বেগম বলেন, ‘বাড়িতে শিমের গাছে এ সময় জাবপোকা বাসা বাঁধে, আবার পাতা হলদে হয়ে যায়, গাছ মরে যাচ্ছে কিছু। পাতা ঝরে যায়। শীমের ফুলগুলো ঝরে পড়ে।’ এর থেকে প্রতিকার পেতে তিনি নিয়মিত গাছের গোড়ায় ভাতের মাড় দেন, একইসাথে বৈর্দমিক্সার তৈরি করে। আবার নিমপাতা ভিজিয়ে রেখে সেই রসআলা পানি ছিটিয়ে দেন। তিনি আরো বলেন, ‘আমরা নিজেরা ভার্মিকম্পোস্ট তৈরি করি, এই সার দিলে গাছের ক্ষমতা বাড়ে। পানের বরজ চাষী মো: রবিউল (৪৯) বলেন, ‘শীতের সময় যখন ঘন কুয়াশা এবং শৈত্যপ্রবাহ হয় তখন আমরা পানের বরজের চারপাশ দিয়ে পলিথিন দিয়ে ঢেকে দেই যাতে ঠান্ডা হওয়া বাতাস বা কুয়াশা ডুকতে না পারে।’ তিনি আরো বলেন, ‘সাধারণত উত্তরের দিক থেকে বেশি বাতাস প্রবাহিত হয়। তাই পানের বরজের উত্তর দিক দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। বাণিজ্যিকভাবে চাষ করছে কৃষক আমিন উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘এই শৈত্যপ্রবাহ থেকে ফসল শাকসবজি রক্ষায় আমি কীটনাশকের দ্বারস্থ হচ্ছি। কোন উপায় না পেয়ে তিনি কীটনাশক ব্যবহার করছেন। শীতের সময়ে তিনি ভিটামিন এবং ছত্রাননাশক কীটনাশক ব্যবহার করছেন। কিন্তু তাঁর সাথে কথা বলে জানা যায়, যারা পাশের জমিতে জৈবসার ব্যবহার করছে তাদের তুলনায় ফলাফল কম দিয়েছে। এরকম একজন চাষী পিয়ারু মিয়া বলেন, ‘আমার কপির গাছ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’

উপসংহার
মাঠ পর্যবেক্ষণ এবং কৃষক-কৃষাণীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, যারা জমিতে জৈবসার বেশি ব্যবহার করেছেন, তাঁদের ফসলে রোগ পোকার আক্রমণ কম। এবং একই সাথে এই শীত এবং তীব্র ঠান্ডা শৈত্যপ্রবাহেও জমির ফসল ভালো আছে। অন্যদিকে রাসায়নিক কীটনাশক বেশি ব্যবহারিকারিদের জমিতে রোগ পোকার আক্রমণও বেশি এবং একই সাথে ফসল উৎপাদনের খরচ বেড়ে গেছে। কৃষকদের সাথে আলোচনা কালে জানা যায়, দিনে দিনে বাণিজ্যিক চাষের সম্প্রসার হবার কারণে স্থানীয় কৃষিজ্ঞানগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। আগে জমিতে ফসল চাষে লোকায়ত চর্চাগুলো অনেক বেশি প্রয়োগ হলেও তা চর্চার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ জলবায়ু এবং প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষায় পরিবেশবান্ধব কৃষি চর্চার বিকল্প নেই। সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে এই উদ্যোগগুলো আরো বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করেন স্থানীয় প্রবীণ কৃষকরা। উল্লেখ্য যে, উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক বড়গাছি কুষকদের মধ্যে দীর্ঘ আট বছরের বেশি সময় থেকে স্থানীয় কৃষি চর্চা এবং জৈবকৃষি দিকগুলো নিয়ে অভিজ্ঞতা বিনিময় করে। উক্ত এলাকায় প্রায় ৩৫টি পরিবার ভার্মিকম্পোস্ট সার তৈরি করে ব্যবহার এবং বিক্রি করেন। এর ফলে এই এলাকায় জৈবকৃষি চর্চা সুফলগুলো অনেক কৃষক পাচ্ছেন। নিজেরা সেই চর্চাগুলো নিজেদের মধ্যে বিনিময় করেন।

happy wheels 2

Comments