গবাদিপশুর গ্রাম্য চিকিৎসক খোন্দকার জামাল উদ্দিন

মানিকগঞ্জ থেকে মো. নজরুল ইসলাম

আদিম সাম্যবাদী যুগ খেকে আমরা জানতে পারি যে, হাঁস, মুরগী, গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া, উট, দুম্বা ইত্যাদি মানুষের ভোগের উপযোগী। অন্যদিকে উৎপাদনের হাতিয়ার ও অর্থনৈতিক মুক্তির চালিকাশক্তি। সনাতন ধর্ম মতে গাভী হলো মায়ের সমান তাই তারা গাভীকে দেবতার মত সম্মান করে। গ্রামীণ প্রবাদ মতে গবাদি পশু হলো সংসার এর লক্ষী, তার দ্বারা কোন ক্ষতি হয় না বরং সন্তানের চেয়েও কোন অংশে কম নয়। তাই গ্রামীণ নারীরা সংসারে গবাদি পশুকে আকড়ে ধরে, তাকে ভালবাসে, কোন কারণে অসুখ বিসুখ হলে বা বিয়োগ হলে কান্নায় ভেঙ্গে পরে।

আগের দিনে গবাদি পশুর রোগ ব্যাধি অনেকাংশে কম ছিল। কারণ প্রচুর পরিমাণ প্রাকৃতিক উৎস ছিলো এবং সামান্য রোগব্যাধি থাকলেও লোকায়ত পদ্বতিতেই সেরে যেতো। আধুনিক এই যান্ত্রিক যুগে সার-বিষ কিটনাশকের ব্যবহার বাড়াতে মানুষের পাশাপাশি গবাদিপশুর রোগ ব্যাধিও কয়েকগুণ বৃদ্বি পেয়েছে। এমতাবস্থায় সমাজে প্রচুর প্রয়োজন ও চাহিদা রয়েছে গ্রাম্য চিকিৎসক খোন্দকার জামাল উদ্দিনের মত অসংখ্য পল্লী চিকিৎসকের।

পল্লী ডা. খোন্দকার জামাল উদ্দিন (৬০) বলেন, “ছোট বেলা থেকেই গরু-বাছুর এর প্রতি প্রচুর ঝোক। গরু ছাগলের অসুখ বিসুখ হলে আমি টের পাই এবং যত্ন নেই। তখন থেকেই মনে মনে সংকল্প ছিলো পল্লী চিকিৎসকের প্রশিক্ষণ করে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে গবাদিপশুর চিকিৎসা করবো। গবাদি পশু ভালো থাকলে আমার মন ভালো থাকবে। মানুষের সেবা হবে দুইটা পয়সাও রোজগার হবে”।

উথলী হাসপাতাল থেকে এক সপ্তাহ এবং পরে সাভার ভেটেরিনারি গবেষণা কেন্দ্র থেকে ৬ মাসের গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগী পালনের উপর সরকারি পল্লী চিকিৎসক কোর্সে করেন তিনি। এই সনদ দিয়েই তার সরকারি চাকরি হয়েছিলো। যোগদান করেছিলেন সিলেটে। তিনি বলেন, “প্রশিক্ষণ শেষে বাড়িতে আসার পর মা আমাকে আর যেতেই দিল না, আমারও ইচ্ছা করছিলো না এত দূরে গিয়ে চাকরি করতে। এলাকায় থাকতেই আমার বেশি ভালো লাগে। এলাকাও নাম ছড়িয়ে পড়লো জামাল ডাক্তার আসলেই গরু-বাছুর এর রোগ ভালো হবে। আমি গরুর গায়ে হাত দিয়েই বলতে পারি এটি ভালো হবে কি হবে না। সুস্থ হলে চিকিৎসা করি ওষুধের দাম নেই এবং খুশি হয়ে আমাকে যে মজুরি দেয় তাই নেই।” এভাবে বালিয়াখোড়া ইউনিয়নের গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে সবাই জামাল ডাক্তার নাম ডাক বাড়তে থাকে।

আশির দশকের শেষ দিকে এরশাদ সরকার এর আমলে পল্লী চিকিৎসকদের সরকার ডাকে এবং উপজেলা ভিত্তিক একটি সমিতি গঠন করা হয়। এই সমিতির মাধ্যমে তাদেরকে এলাকা ভাগ করে দেয়া হয় এবং সরকারি ডাক্তারদের সাথে ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রমসহ জরুরী যে কোন কাজে তাদেরকে থাকতে বাধ্যতামূলক করা হয়। এর বিনিময়ে তারা কিছু সুযোগ সুবিধাও পাইতো। বর্তমান সরকারের আমলে পল্লী চিকিৎসকদের কোন সুযোগ সুবিধা নাই-এমনটা মন্তব্য করেন তিনি। আশার কথা হলো সরকারি ভ্যাকসিনও মৌসুম ভিত্তিক রোগগুলোতে সরকারি ওষুধ গুলো বাজারের ওষুধের চেয়ে হাজার গুণ বেশি কাজ করে এবং বিদেশ থেকে আসার কারণে এগুলো খুবই ভালো কাজ করে। সমস্যা হলো পর্যাপ্ত থাকে না, থাকলেও টাকা দিয়ে ক্রয় করে আনতে হয়। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “এই সরকার একটি কাজ করেছে যে প্রতি ইউনিয়নে ৩টি কমিউনিটি ক্লিনিকের বিপরীতে একজন করে নিবন্ধিত পল্লী চিকিৎসক কাজ করবে। দু:খের বিষয় হলো আমার ইউনিয়নে এই পেশায় আমি আর রতন ছাড়া আর একজনও বাড়ে নাই।” এই প্রজন্ম চাকরি চায়, কাজ করতে চায় না। গবাদি পশুর ওপর লেখাপড়া করলে যে ভবিষ্যত ভালো এটি বুঝিয়েও তিনি তার এলাকার যুব সমাজকে লাইনে আনতে পারেননি।

তিনি এই পেশায় থেকে খুবই আনন্দিত ও সুখী। তিনি প্রাণী সম্পদের তথা মানব সেবায় একজন নিবেদিত সৈনিক হিসেবে নিজেকে দাবি করেন। তিনি মনে করেন, “বেসরকারি ক্লিনিক ও ওষুধ ব্যবসায়ীরা বোবা প্রাণীর ওষুধ নিয়ে শুধু ডাকাতি নয়; সন্ত্রাসী করছে। এই অসাধু কোম্পানির মালিকদের জেলে ভরা উচিত।”

বর্তমান ওষুধের ভয়ংকর দাম দেখে ভালো লাগে না তার; আবার গরিব মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে অনেক মায়া লাগে। সব কিছু মিলিয়ে চিকিৎসাখাত আগের মতো নেই। মানুষও আগের মতো নেই। গবাদি পশুরাও শারিরিক পরিবর্তনসহ চরিত্র পাল্টে গিয়েছে। আগের দিনে অধিকাংশ পরিবারে ছিলো কৃষি খামার তারা সকালে গরু দিয়ে হাল চাষ করতো। বতরের সময় মলন দিতো। নদীতে, খালে , মাইটালে, পুকুরে গরু ঝাপাইতো বা গোসল করাতো। গরু ছাগলগুলো নিজেরাও পরিশ্রম করতো এবং মাঠে ঘুরে বিচরণ করে খেতে হতো। কাটা ঘাস-খড় কম লাগতো, ফলে রোগ-ব্যধিও কম হতো। এখন আধুনিক পদ্বতিতে গরু মোটাতাজাকরণ করা যায় বিধায় অধিক লাভের আশায় মানুষ এই প্রক্রিয়া অবলম্বন করে। ফলে গবাদি পশুকে আরামে যত্নে রাখতে হয়, ফ্যান দিতে হয়, মোটর দিয়ে গোসল করাতে হয়। ব্রয়লার মুরগীর মত ঝুঁকিও অনেক গুণ রেড়ে যায় বলে ডাক্তার জামালের অভিজ্ঞতা। তারপরও গ্রামেও এখন এই প্রক্রিয়ার প্রতি আগ্রহ বেশি। কি আর করা, গ্রামীণ প্রবাদে আছে না “যে দেশে যে বাউ, উক্তা করে নাউ বাউ”।

এই ভাবেও যে তিনি চলতে পারেন না, তার বিবেক বাঁধা দেয়। এখন আর কাজে যেতে মন বসে না তার; দেশের অবস্থা ভালো না। করোনাকালে এখন কেউ নিরাপদ নয়, পল্লি চিকিৎসকেরা লকডাউন এর আওতায় না থাকলেও সরকারি ভাবে পিপিই না পাওয়াতে এই যাত্রায় গৃহবন্দি আছেন। প্রতিদিনই তার কাছে ফোন আসে, ফোনেই সমাধান দেন। মানুষও এখন বেশ চতুর বিধায় আগের মত আনন্দ পান না তিনি কাজে।

বর্তমানে গরিব মানুষের হাতে প্রাণীসম্পদ নেই; চলে গেছে ধনী খামারীদের হাতে। শিক্ষা খাতের মত স্বাস্থ্য খাতও এখন ধনীক শ্রেণীর হাতে জিম্মি। এই জিম্মিদশা থেকে আমরা মুক্তি চাই। আমরা যেন করোনা থেকে আদর্শ মানুষ হওয়ার শিক্ষা নেই, ব্যক্তিমালিকানার সমাজ আজ পরাজিত এটা প্রমানিত সত্য। তাই আসুন সমাজিক মালিকানার সমাজ প্রতিষ্ঠায় নিজেকে নিবেদন করি।

happy wheels 2

Comments