কচুরিপানার বহুমুখী ব্যবহার

কলমাকান্দা, নেত্রকোনা থেকে অর্পণা ঘাগ্রা

কচুরিপানার স্থানীয় নাম র্জামুনী। প্রায় প্রত্যেকের কাছে এটি অতি পরিচিত একটি জলজ উদ্ভিদ। নদী, নালা, খাল, বিল, জল ও জলাশয়ের যেকোন পরিবেশে এটি জন্মে। তবে হাওরঞ্চলে এটি দ্রুত ও ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করে। যারা এর ব্যবহার ও উপকারিতা জানেন তাদের কাছে এটি একটি সম্পদ। আবার যারা এর ব্যবহার পদ্ধতি আয়ত্ব করতে পারেনি তাদের কাছে এটি একটি আগাছা ও বিড়ম্বনার। তাই এই সম্পদটির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হলে অনেক কৃষক উৎপাদন খরচ হ্রাস করতে পারবেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। এই লেখায় কচুরিপানা ব্যবহারকারীদের কিছু উদ্যোগ তুলে ধরা হয়েছে।

dsc01789

কচুরিপানার বহুমাত্রিক ব্যবহার
কলমাকান্দা উপজেলার বরখাপন ইউনিয়ন একটি হাওর অধ্যূষিত অঞ্চল। এই এলাকার প্রায় সর্বত্রই কচুরিপানা ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। এখানকার কৃষকরা কচুরিপানা ব্যবহার করেন বিভিন্নভাবে। অনেকে ভাসমান সবজি চাষের কাজে, অনেকে মাছের খাবার হিসেবে, কেউ কেউ জৈব সার, গবাদি পশুর খাবার, রাস্তা গর্ত হয়ে গেলে রাস্তা ভরাট করা, নতুন রাস্তা পিচ করা হলে বার বার পানি দেয়ার ঝামেলা এড়ানোর জন্য ও পিচ করা মজবুত করার জন্য রাস্তার উপর বিছিয়ে রাখা,  সিমেন্টের  খুটি তৈরি করে তা মজবুত করার জন্য ও পানি ধরে রাখার জন্য তার উপর বিছিয়ে দেয়া, কচুরিপানার শিকর দিয়ে বল তৈরি করে সেখানে বীজ অঙ্কুরোগমন করানো, গোল আলু মালচিং করার কাজে, আবার কেউ কেউ আফালের (ঢেউ) হাত থেকে বসত ভিটে রক্ষার কাজে কচুরিপানা ব্যবহার করেন।

ভাসমান সবজি চাষ
রানাগাও গ্রামের কৃষাণী মালতী রানী দাসের বসতভিটের চারপাশ প্রায় ৬-৭ মাস পর্যন্ত পানিতে নিমজ্জ্বিত থাকে। এই সময় সবজি চাষ করার মত পর্যাপ্ত জায়গা তাঁর নেই। তাই তিনি প্রতিবছরই কচুরিপানা দিয়ে ভাসমান সবজি চাষ করেন। এতে করে সবজি ক্ষেত্রে তার পারিবারিক চাহিদা মিটে যায়। উপরোন্তু তিনি কিছু শাকসবজি বিক্রি করে বাড়তি আয় করতে পারেন। ভাসমান সবজি চাষের জন্য তিনি প্রথমে বাঁশ দিয়ে মইয়ের আকারে বেড তৈরি করেন। পরবর্তীতে তার উপর কচুরিপানা বসান। একবার কচুরিপানা বসানোর পর ৩-৪ দিন পর পর পর্যায়ক্রমে কচুরিপানা বসান। কচুরিপানার উপর নীচ সব অংশ কয়েকদিনের মধ্যে পুরো পচে সার তৈরি হলে তার উপর শাকসবজির বীজ বপন করে দেন। যার যার চাহিদা ও জায়গা অনুসারে কয়েকটি বেড তৈরি করেন। dsc01804বেডের আকার ও আয়তনও যার যার পছন্দ অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন সাইজের হতে পারে। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নিয়ম অনুসারে দৈর্ঘ্য ৬০ মিটার এবং প্রস্থ ৩ মিটার আকারের হয়ে থাকে। একেকটি বেডে একেকটি সবজি (লাল শাক, কলমি শাক, পুই শাক, ডাটা, মুলা শাক প্রভৃতি) চাষ করা হয়। পানির উচ্চতা বাড়ার সাথে সাথে সবজির এই বেডগুলো পানির উপরে ভাসতে থাকে। পানি কমে গেলে নীচে নামতে থাকে। এ কারণে এর নামকরণ করা হয় ভাসমান সবজি চাষ। এভাবে একেবারে পানি শুকিয়ে গেলে বেডগুলো মাটির সাথে লেগে যায়। আর তখন বেডগুলো জৈবসার হিসেবে জমিতে ব্যবহার করা হয়।

সার ও বসতভিটা মজবুতকরণ
অপর এক কৃষাণী কাজল রাণী দাস কচুরিপানা ব্যবহার করেন গাছের গুড়িতে, শীতকালীন সবজি বাগানে ও আফালের হাত থেকে বসত ভিটে রক্ষার কাজে। তিনি বলেন, “গাছের গুড়িতে কচুরিপানা  দিলে গাছ বল পায়, তাড়াতাড়ি বাড়ে। শাকসবজি ক্ষেতে দিলে জমি সারের কাজ করে। বাইরে থেকে আমার আর সার কিনতে হয় না। গোল আলু ক্ষেতে দিলে বীজ সুন্দরভাবে গজায়।” তিনি আরও বলেন, “কচুরিপানা আমার বসতভিটে আফালের হাত থেকে রক্ষা করে।”
dsc01792
মাছের খাদ্য ও নিরাপদ আবাসস্থল
কাগজীপাড়া গ্রামের অধিকাংশ পরিবার মৎস্যজীবী। শাকসবজি বাগানে জৈব সার হিসেবে ব্যবহার ছাড়াও কচুরিপানার কদর তাদের কাছে আরো ভিন্ন ধরনের। মৎস্যজীবি সুধানন্দ দাস মেদা বিল থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। মৎস্যজীবীদের কাছে কচুরিপানার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তিনি বলেন, “বিলের পানি শুকাতে শুরু করলে মাছগুলোর জন্য ঠান্ডা আবাসস্থল তৈরি করতে হয়। আর তার জন্য বিলের মাঝখানে আমরা কার্তিক মাস থেকে কচুরিপানা দিয়ে কাটা দিই। পৌষ-মাঘ মাসে সেই কাটা ভাঙি। কচুিরপানা দিয়ে কাটা দিলে সেখান থেকে অনেক মাছ পাওয়া যায়। কারণ কাটায় আইসা মাছগুলো একসাথে জমা হয়। কাটা দেয়ার সময় কচুরিপানাগুলো একসাথে রাখার জন্য বাঁশের লাঠিগুলো পুঁতে আবার বাঁশ দিয়াই বাইন্দা দিই।” তিনি আরও বলেন, “এতে করে পানি গরম হলে গরমের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য কচুরিপানা যেখানে জমা থাকে সেখানে মাছগুলো আইসা আশ্রয় নেয়। তাছাড়া কচুরিপানার কালো শিকড়গুলোতে অনেক শেওলা জমে, সেই শেওলাগুলো মাছ খায়। শিং, কই, চিংড়ি, মাগুর, টেংড়া, ভেদুরী, লাটি, কইল্যা, সইল্যা, কাইক্কা, চান্দা, চিকড়ি বাইন প্রভৃতি মাছ কচুরিপানার শিকর ও শেওলা খাইতে বেশি পছন্দ করে।”

মাছ চাষ
পুকুরে মাছ চাষ করা অনেক ব্যয়বহুল। কারণ মাছের জন্য বাজার থেকে খাবার ক্রয় করতে হয়। তাই অনেক মাছ চাষী আছেন যারা  খরচ কমাতে ও মাছের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করাতে কচুরিপানা দিয়ে মাছ চাষ করেন। dsc01802কলমাকান্দা সদর ইউনিয়নের ওমরগাও গ্রামের এমনই একজন কৃষক মো. শাহজাহান যিনি ৭২ কাঠা পরিমাণ জমির পুকুরে মাছ চাষ করেন শুধুমাত্র কচুরিপানা দিয়ে। তিনি কচুরিপানা দিয়ে মাছের খাদ্য উৎপাদন করার প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলেন “প্রথমে কচুরিপানা পুকুরের যেকোন জায়গায় জমা করি, তার উপর কিছু খইল ও কুড়া ধাপে ধাপে রাইখা দিই। এভাবে ৬-৭ দিনের মধ্যেই কচুরিপানা পচে গেলে মাছ নিজেরাই সেই খাবার খাইয়া নেয়। আর তা পুকুরের সব জায়গায় ছিটাইয়া দিতে হয় না।” তিনি আরও বলেন, “যে জায়গায় কচুরিপানার পচা ঢিবি থাকে সেখান খেকেই মাছগুলো আইসা খায়। এই খাবার মাছ মাছ অনেক পছন্দ করে, তাড়াতাড়ি বড় হয়, আর আমার খরচও অনেক কম হয়”। তাছাড়া আকশ্মিক বন্যার সময় পুকুর প্লাবিত হলে সব মাছ পানির সাথে সাথে ভেসে যায় তখন মাছগুলোর ভেসে যাওয়া রোধ করার জন্য কচুরিপানা দিয়ে  অনেক মাছচাষী পুকুর পাড় বাঁধ দেন।

গবাদি পশু খাদ্য
গবাদি পশু পালন করাও হাওরঞ্চলের জন্য বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়। কারণ বছরের ৬-৭ মাস পর্যন্ত গবাদি পশুর জন্য ঘাস সংকট দেখা দেয়। শুকনো খড় খাওয়াতে খাওয়াতে গরুগুলো রোগা হতে শুরু করে। তারপরও মানুষ গবাদি পশু পালন করেন। সদর ইউনিয়নের চানপুর গ্রামের কৃষাণী  শিলা সরকার ছোট্ট বসতভিটের এক কোনে গরু, ছাগল ও ভেড়া পালন করেন। যেহেতু তিনি জমি চাষ করেন না তাই গবাদি পশুর জন্য তার কোন খড় মজুদ নেই। বর্ষাকালে জমির চারপাশে পানি থাকায় গবাদি পশু চড়ানোর মত কোন জায়গা নেই। তাই সারা বর্ষাকাল তিনি গরু, ছাগল ও ভেড়ার জন্য কচুিরপানা খাওয়ান। তাছাড়া যারা বছরের ছয় মাস যাবৎ খড় খাওয়ান তারাও কচুরিপানা খাওয়ান। কারণ শুকনো খড় খাওয়াতে খাওয়াতে গরুশুলো রোগা হয়ে যায়। কচুরিপানা খাওয়ালে গরু মোটা হয়। স্বাস্থ্য ভালো থাকে। তাছাড়া গোয়াল ঘরে বর্ষার সময় অনেক কাদা হয়। সেই কাদাতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় গরুগুলোর নানান ধরনের রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। তাই কাদার হাত থেকে গরুগুলোকে রক্ষা করার জন্য গোওয়ালঘরেও কচুরিপানা বিছিয়ে দেন। যেন কাদা কম হয়। গরুর পায়ে পিষ্ট হয়ে কচুরিপানাগুলো গুঁড়ো হয়ে গেলে সেগুলো আবার জমিতে সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

হাঁসের খাদ্য
মধ্যনগর গ্রামের কৃষাণী জোৎস্না বেগম সারাবছরই ২০-২৫টি হাঁস পালন করেন। বছরব্যাপী হাঁস ও হাসেঁর ডিম বিক্রি করে সংসারের জন্য বাড়তি উপার্জনের পথ সৃষ্টি করেছেন। এ থেকে তার বছরে ৮০০০-১০,০০০/ টাকা আয় হয়। তিনি হাওর থেকে কচুরিপানা তুলে নিয়ে এসে হাঁসের ছানাগুলোর সামনে বিছিয়ে দেন। তখন হাসেঁর ছানাগুলো কচুরিপানার শিকড়, শিকড়ে আটকে থাকা ছোট ছোট মাছের পোনা ও কীটপতঙ্গ গুলো খায়। এতে করে হাঁসের ছানার জন্য তার বাড়তি খাবার ক্রয় করার খরচ বেচে যায়।

বর্তমানে ভাসমান সবজি চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য সরকারিভাবে কিছু কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। সরকারি/বেসরকারি এই এই কার্যক্রমে জনগোষ্ঠীকে আরো বেশি সম্পৃক্ত করা হলে কচুরিপানার যথাযথ ব্যবহার আরো বেশি বৃদ্ধি পাবে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ব্যবহার পদ্ধতিগুলোর বিস্তৃতির মাধ্যমেও কচুরিপানাকে সম্পদে পরিণত করার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই কচুরিপানার ব্যবহার পদ্ধতি সম্পর্কে জনগোষ্ঠী ব্যপক ধারণা লাভ করলে কচুরিপানা আগাছার পরিবর্তে প্রাকৃতিক সম্পদ হয়ে উঠবে।

happy wheels 2