‘লেছড়াগঞ্জ চরউন্নয়ন কৃষক সংগঠন’ চরের প্রান্তিক উন্নয়নে কাজ করছে

হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ থেকে মুকতার হোসেন

আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার পদ্মা নদীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপচর লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়ন’র পাটগ্রাম চরের ১০ জন প্রান্তিক নারী ও ১২ জন পুরুষ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০১২ সালে গড়ে তোলেন ‘লেছড়াগঞ্জ চরউন্নয়ন কৃষক সংগঠন’।

হরিরামপুর উপজেলার লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়ন একটি দ্বীপচর। উপজেলা সদরের মূলভূমি থেকে নৌকায় এক ঘণ্টা পদ্মানদী পাড়ি দিয়ে দূর্গম এই চরে যেতে হয়। এখানে প্রতিবছর বন্যার কারণে চরববাসীর ফসলি জমি তলিয়ে যায়। প্রতিবছর প্লাবনের পানির সাথে বয়ে আসা পলি-কাদা-বালির কারণে চরাঞ্চলের কৃষিজমির মাটির বুনট, গঠন, সংযুতি ও গুণগতমান পরিবর্তন হয়। এক বছরের উর্বর জমি পরবর্তী বছরের প্লাবনে বালিময় হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই কৃষিজমির মাটি ও আনুষাঙ্গিক পরিবেশ-প্রতিবেশ বিবেচনায় নিয়ে বদলে যাওয়া মাটির ধরন অনুযায়ী চরের কৃষকরা ফসল নির্বাচন করে চাষাবাদ করেন। প্রতিনিয়তই এখানকার কৃষকদের অভিযোজন কৌশল অবলম্বন করে জীবন-জীবিকা পরিচালনা করতে হয়। লেছড়াগঞ্জ চরের প্রান্তিক জনগোষ্ঠি চরাঞ্চলের জীবনযাপন, বসবাসের দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা, স্থানীয় চর্চা, জ্ঞান-দক্ষতা দিয়েই খাপ-খাওয়ানোর কাজটি করেই বন্যা, খরা, নদী ভাঙন, অতিবৃষ্টি বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

চরাঞ্চলে চাষউপযোগী ফসলের কৃষিবীজ নিজেদের সংগ্রহে রাখা ও সহজপ্রাপ্তির জন্য ‘লেছড়াগঞ্জ চরউন্নয়ন কৃষক সংগঠন’ মোছা. হাজেরা বেগমের বাড়িতে স্থানীয় জাতের বীজ সংরক্ষণ কেন্দ্র বা কৃষকবীজ ব্যাংক তৈরি করে। এই কৃষক বীজ ব্যাংক আউশধান, বাদাম, যব, পায়রা, তিলসহ বর্তমানে ৫০ ধরনের ফসলের বীজ রয়েছে। পাটগ্রামচর, হালুয়াঘাটা, খরিয়াচর, নটাখোলা, গঙ্গাধরদিসহ আশেপাশের ৬-৭ গ্রামের মানুষ কৃষক বীজব্যাংক থেকে বীজসংগ্রহ ও বীজ বিনিময় তাদের বীজের চাহিদা মেটান। লেছড়াগঞ্জ চরউন্নয়ন কৃষক সংগঠন’র সভাপতি মোছা.হাজের বেগম জানান, সংগঠনের পক্ষ থেকে গ্রামবাসীদের বীজ ছাড়াও কৃষি পরামর্শ, প্রয়োজনীয় নানা তথ্যাদি দিয়ে সহযোগিতা করা হয়। চরের নারীরা গতবছরে কৃষক বীজব্যাংক থেকে বীজ নিয়ে বসতবাড়িতে লাউ, মিষ্টি কুমুড়া, চালকুমড়া, ঝিংগা, ধুন্দল, মরিচ, আদা, হলুদ, সজিনা চাষাবাদ করে পরিবারে খাবারের পর বিক্রি করে অনেকেই পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকা আয় করেছেন, যা নিজের খরচের জন্য ব্যয় করেছেন।

‘লেছড়াগঞ্জ চরউন্নয়ন কৃষক সংগঠন’র কয়েকজন উদ্যোগী কৃষক বিগত ২০২০ সালে চরে চাষ উপযোগী আউশ ধানজাত নির্বাচনের লক্ষ্যে হরিহরদিয়া গ্রামে ২৯ ধরনের স্থানীয় জাতের আউশ পরীক্ষণ প্লটে লাগিয়ে জাত নির্বাচন গবেষণা পরিচালনা করেন। সংগঠনের সহায়তায় চরের কৃষকরা বাসমতি ও আউশ ধান বীজ পেয়েছেন। কৃষক সংগঠনের সদস্যরা বিগত ২০২০ সালে বালুচরে মিষ্টি কুমড়ার প্রথম পরীক্ষণমূলক চাষাবাদ করেন। সংগঠনের উদ্যোগে কৃষকরা বসতবাড়িতে আদা-হলুদও বিভিন্ন ধরনের সবজি বীজ সহায়তা এবং পুকুর সংস্কারের মাধ্যমে যৌথ উদ্যোগে মাছ চাষচাষ পরিচালনা করেছেন। বর্তমানে বৈশ্বিক মহামারী করোনা সচেতনতায় চরজনগোষ্ঠির মধ্যে ‘লেছড়াগঞ্জ চরউন্নয়ন কৃষক সংগঠন’ বিভিন্ন সচেতনতা কার্যক্রম করছেন। এছাড়া ‘লেছড়াগঞ্জ চরউন্নয়ন কৃষক সংগঠন’ আয়োজনে বীজমেলা, নবান্নসহ নানা ধরনের অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। কৃষক সংগঠনের এই কার্যক্রমের মাধ্যমে চরাঞ্চলে চাষ উপযোগী ফসলের বীজ যেমন সহজলভ্য হয়েছে তেমনি চরের বিভিন্ন গ্রামের মানুষের মধ্যে আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।

Exif_JPEG_420

‘লেছড়াগঞ্জ চরউন্নয়ন কৃষক সংগঠন’র সভাপতি হাজের বেগম জানান, সংগঠনের সদস্যরা মাসিক সভায় কৃষিসহ চরাঞ্চলের সামাজিক সমস্যা যেমন মাদকাসক্তি, বাল্যবিয়ে, পারিবারিক নির্যাতন, শিশু-কিশোরীদের বিনোদন, স্বাস্থ্য-পুষ্টি-পরিচ্ছন্নতা, সরকারি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির সুযোগ-সুবিধা, সরকারি প্রশিক্ষণে যুব ও নারীদের অন্তর্ভূক্তির জন্য যোগাযোগ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। চরাঞ্চলের সামাজিক নেতৃবৃন্দ ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ ও সমম্বয়ের মাধ্যমে এই সব কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য সংগঠনের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। ডিয়াকোনিয়া প্রতিনিধিবৃন্দ ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘লেছড়াগঞ্জ চরউন্নয়ন কৃষক সংগঠন’র সাথে আলোচনা ও চরবাসীর নানাবিধ উন্নয়ন উদ্যোগ প্রত্যক্ষ করেন।

উল্লেখ্য যে, বারসিক-হরিরামপুর রিসোর্স সেন্টার ২০১০ সাল থেকে হরিরামপুর উপজেলার ৪টি চরের প্রায় ৭০০০ জনগোষ্ঠির মধ্যে পরিবেশ-প্রকৃতি সুরক্ষা, চর উপযোগী স্থানীয় জাতের শস্য-ফসলের বীজ সংরক্ষণ, চাষাবাদ, প্রসার ও জনগোষ্ঠির আর্র্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।

happy wheels 2

Comments