সামাজিক সংঘাত: উন্নয়নের অন্তরায়
:: নেত্রকোনা থেকে মোঃ আলমগীর
সংঘাত: অতীত ও বর্তমান চিত্র
ইতিহাস পাঠে বা বিজ্ঞান বা ধর্মীয় বিভিন্ন ব্যাখ্যায় জানা যায়, সৃষ্টি সেরা জীব মানুষ যেভাবেই হোক না কেন নিজেদের সুখ-কল্যাণ ও ভালো থাকা নিশ্চিত করার জন্য পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল ছিলো। সমাজের তারা একতাবদ্ধভাবে বাস করতো। একে অপরের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করতো। এর ফলশ্রুতিতে সৃষ্টি হয় সামাজিক রীতনীতি, মূল্যবোধ, আচার-অনুষ্ঠান তথা সংস্কৃতি। সৃষ্টি হয় পারস্পারিক নির্ভরশীলতার বহুমাত্রিক সম্পর্কও। এ সম্পর্কের গুণে মানুষ একে অপরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতো। তবে আধুনিক সমাজব্যবস্থায় বিশেষ করে পুঁজিবাদী সমাজ সৃষ্টির পর থেকে মানুষের ভেতরের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, আস্থা, আন্তরিকতা লোপ পেতে থাকে। এর স্থলে সমাজে জন্ম নেয় লোভ-লালসা, দখল, বিভেদ, আধিপত্য, দাম্ভিকতা, সংঘাত, অসুস্থ প্রতিযোগিতা, হিংসা। এর ফলে সমাজে তৈরি হয় অস্থিতিশীলতা, অসাম্য, বৈষম্যসহ আরও নানা নেতিবাচকতা, যা মানুষের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করে তুলে।
এমন না যে, অতীতে সংঘাত বা অস্থিতিশীলতা ছিল না। সংঘাত অবশ্যই ছিল তবে সেটি যতটা সম্পদকে ঘিরে হতো তার চেয়ে বেশি হতো জাত বা বংশকে কেন্দ্র করে! মূলত জাত বা বংশকে রক্ষা করতে গিয়ে মানুষ সংঘাতে জড়িয়ে পড়তো। এই সংঘাত প্রশমনের হাতিয়ার মানুষের কাছেই ছিলো। নেত্রকোনা এলাকার বিভিন্ন গ্রামের বয়স্ক মানুষের সাথে আলোচনায় জানা যায়, বংশ বা জাত, গোত্র যাই বলি না কেন, সেটা রক্ষা করা কিংবা সেই জাত বা বংশকে অন্যের কাছে তুলে ধরার জন্য মানুষ নানা ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ করতো। কোন বংশের সাথে অন্য আরেকটি বংশের সংঘাত হলে অন্য বংশের মানুষেরা সেটা প্রশমনের চেষ্টা করতো। এছাড়াও সমাজে স্থিতিশীলতা, শান্তি এবং সংঘাত প্রশমনের জন্য তখনকার মানুষ বিভিন্ন ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজন করতো। বিনোদনের মাধ্যমে মানুষকে তথ্য প্রদান ও সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়তা করতো। প্রকৃতির পাঠশালা থেকে জ্ঞান আহরণ করে নিজেদের সমৃদ্ধ করতো মানুষ। বিভিন্ন প্রাকৃতিক উৎস থেকে নানান ধরনের সম্পদ সংগ্রহ ও রক্ষার করতো তারা এবং এ সম্পদকে রক্ষা ও সংরক্ষণের প্রতিযোগিতায় তাদেরকে আনন্দ দিতো। তখনকার মানুষের ভেতরে সংঘাত নয়, বরং সুস্থ প্রতিযোগিতা ছিল যে, সমাজ উন্নয়নে কে কতটা বেশি ভূমিকা রাখতে পারে!
আধুনিক সংঘাতের নেপথ্য কারণ
একজন উন্নয়ন কর্মী হিসেবে প্রায় দেড় যুগ ধরে বিভিন্ন মানুষের সাথে চলাফেরা, মিথস্ত্রিয়া এবং সম্পর্ক তৈরির অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি যে, বর্তমানে গরিষ্ঠভাগ মানুষের মূল ও একমাত্র লক্ষ্যই হলো সম্পদ বৃদ্ধি করা, সেটা যেকোনভাবেই হোক! সম্পদ বৃদ্ধি করাকে কেন্দ্র তাদের মধ্যে চলে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এ সম্পদ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যকে হাসিল করার জন্য তারা সামাজিক বা রাষ্ট্রের রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান আইন কানুন, মূল্যবোধ, নৈতিকতাকে তোয়াক্কা করেন না। সঙ্গত কারণেই আজ গ্রামীণ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, প্রকৃতি-প্রাণবৈচিত্র্য, স্থায়িত্বশীল জীবন জীবিকার কোন মূল্য নেই তাদের কাছে। ‘আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ’ হওয়ার এ অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের ওপর; যাদের কোন প্রভাব-প্রতিপত্তি বা ক্ষমতা নেই! প্রতিযোগিতা বলতে আমরা বুঝি, অনেকের মাঝে একজন বিজয়ী। সমাজ উন্নয়নের নামে নিজের সম্পদ বৃদ্ধির এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়া মানে পরাজয়ের শামিল! কারণ এখানে সমাজ পরাজিত; ব্যক্তি নয়! যে প্রতিযোগিতায় সমাজ জয়ী হয়, সেই সমাজে মানুষের জন্য ভালো ও কল্যাণকর কিছু উপাদান অবশিষ্ট থাকে! কারণ এ জয় পক্ষান্তরে মানুষেরই জয়! বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা বা আত্মকেন্দ্রিকতা এত বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে যে, এখানে সমন্বিত কোন কার্যক্রম নেই, সমষ্টিগত চিন্তা চেতনার কোন মূল্য নেই! তাই তো মানুষ আজ অতীতের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও আচার-অনুষ্ঠানের কথা বার বার স্মরণ করছে। অতীতে মানুষ সীমিত সম্পদের মাঝেও কতটা ভালো জীবনযাপন করতো তার প্রতিফলন আমরা বিভিন্ন গান, কবিতা বা গদ্যে পাই। হাওরের মানুষের এই গান “গ্রামের নও জওয়ান, হিন্দু মুসলমান……আগে কি সন্দুর দিন কাটাইতাম” টিও মানুষের একসময়কার ভালো থাকার কথা বলেছে। এ গানটি এও বলে দেয় আগের সময়টা ছিল সাম্যের সমাজ, সকলেই ছিল ঐক্যবদ্ধ, ছিল না কোন সংঘাত ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব! আবারও আসবে কি সেই দিনগুলো?
সংঘাত প্রশমনে জনউদ্যোগ এবং বারসিক’র দৃষ্টিভঙ্গি
মানুষের ভেতরে বিভেদ বা সংঘাত তৈরি নয় বরং ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে এসে মানুষ কীভাবে তাদের সমষ্টিগত চিন্তা-চেতনা এবং প্রচেষ্টাকে কাজে লাগিয়ে সমাজ উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে সেটাই বারসিক’র মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্যে বারসিক চেষ্টা করেছে মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরি করার, যে সম্পর্কের আলোকে স্থিতিশীল সমাজ বির্নিমাণে মানুষের শক্তিকে কাজে লাগাতে পারে। এক্ষেত্রে বারসিক কোন নিদির্ষ্ট প্রকল্পের কর্মসূচি নিয়ে মানুষের কাছে নিয়ে যায় না বরং সামগ্রিকভাবে মানুষের জীবন-জীবিকা, কল্যাণ এবং ভালো থাকাকে নিশ্চিত করে এমন সামাজিক প্রপঞ্চকে সমান গুরুত্ব দিয়েই বারসিক কাজ করছে। তাই তো বারসিক’র আলোচনায় সমাজ, পরিবেশ, প্রকৃতি, প্রাণবৈচিত্র্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য কোনটিই বাদ পড়েনি! এগুলোকে বাদ দিয়ে সামগ্রিক কোন উন্নয়ন সাধন করাও যায় না। কারণ প্রতিটি বিষয়ই মানুষের জীবন-জীবিকার সাথে সংশ্লিষ্ট। একটি প্রপঞ্চের বিলুপ্তি অন্যটিকে প্রভাবিত করে। তাই আলোচনার ধারাবাহিকতায় বারসিক মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছে, উদ্ব্দ্ধু করেছে এবং মানুষের ভেতর শক্তি ও সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলার কাজ করেছে। ফলশ্রুতিতে কর্মএলাকায় মানুষ সংগঠিত হয়েছে এবং নিজের প্রয়োজনে মানুষগুলো বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তুলেছে যার প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে সমাজে স্থিতিশীলতা আনায়ন।
এভাবে ২০০৬ সালে নেত্রকোণার আটপাড়ার রামেশ্বরপুর গ্রামে গড়ে গড়ে উঠে তুষাইপাড়ের কৃষক সংগঠন। উক্ত সংগঠনের কার্যক্রম সম্প্রসারিত হয়ে বর্তমানে নেত্রকোণা অঞ্চলে ৫২টি পেশাজীবী সংগঠন গড়ে উঠেছে। সংগঠনের সদস্যরা তাদের লক্ষ্যকে সামনে রেখে নিজেদের মধ্যে জ্ঞান, তথ্য, প্রযুক্তি বিনিময় এবং প্রয়োজনে যৌথ উদ্যোগে সমস্যা সমাধানের পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন। বিভেদ, সংঘাত প্রশমনে তারা তিল, তিল করে গড়ে তুলেছেন জনউন্নয়ন কেন্দ্র, জন উন্নয়ন পাঠাগার, যুব তথ্যকেন্দ্র, কিশোরী লাইব্রেরি, জৈব কৃষি ক্লাব, কৃষি ডায়াগনস্টিক সেন্টার, আইপিএম ক্লাব ইত্যাদি সহায়ক প্রতিষ্ঠান। এসব সংগঠন, পাঠাগার, উন্নয়নকেন্দ্র গড়ে তোলার মাধ্যমে মানুষে মানুষে যোগাযোগ, সহভাগিতা ও মিথষ্ক্রিয়ার সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব সংগঠনের আওতায় বিভিন্ন ধরনের গ্রামীণ খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের ভেতরেই মানুষ মধ্যে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বন্ধন আবার সুদৃঢ় হয়েছে। পরচর্চা বা সম্পদ বৃদ্ধির অসুস্থ প্রতিযোগিতার দিকে না গিয়ে মানুষ চেষ্টা করছে গ্রাম বা সমাজের সামগ্রিক উন্নয়ন সাধনে ভূমিকা রাখার। তাই তো প্রত্যেকের সাথে সুখ-দুঃখ সহভাগিতার করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ছোট্ট ছোট্ট উদ্যোগগুলোর মাধ্যমে মানুষ আবার তাদের অতীতের সেই সমৃদ্ধ ঐতিহ্য, উত্তরাধিকার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। লেখাপড়া না জানা মানুষ, যারা ‘মূর্খ’ হিসেবে পরিচিত অনেকের কাছে তারাই এসব উন্নয়ন সংগঠন বা সহায়ক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে বারসিক’র প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায়। উদ্দেশ্য একটাই; সমাজে বিভিন্ন ধরনের অস্থিতিশীলতা দূর করা এবং সংঘাত প্রশমন করা। এ সংগঠনগুলোর ব্যানারে মানুষগুলো যেমন পরিবেশ, লোকায়ত জ্ঞান, প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা ও সংরক্ষণের জন্য সচেনতা তৈরি করেছে, উদ্বুদ্ধ করেছে, একইভাবে সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা সমাধান, সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্যও কাজ করে যাচ্ছে। এসব উদ্যোগ বা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তারা উপলদ্ধি করেছেন সমষ্টিগত শক্তির চেয়ে বড় শক্তি আর নেই! পারস্পরিক একাত্মতা, সংহতি ও সহানভূতিশীলতার চেয়ে বড় মানসিক শান্তি ও প্রশান্তি আর নেই। ব্যক্তি থেকে যখন মানুষ সমষ্টিগত স্বার্থের দিকে নজর রাখে তখন সমাজে স্থিতিশীলতা ও শান্তি তৈরি হয়। সেখানে সংঘাত, বিভেদ বা লোভের কোন অস্তিত্ব থাকে না। এভাবে পারস্পরিক স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আচরণ দেখানোর মাধ্যমে নেত্রকোনা এলাকার মানুষ সংঘাত নিরসণে কাজ করে যাচ্ছে নিরন্তর।