কেঁচো সার পরিবেশ সুরক্ষায় ভূমিকা রাখছে
রাজশাহী থেকে অমৃত সরকার
আমি একটি স্বপ্ন দেখেছিলাম সেই ২০১৫ সালে। সেই স্বপ্ন ছিলো আমার ফসল চাষের ক্ষেত্রে মাটির স্বাস্থ্য ভালো রেখে ফসল ফলাবো। আর সেই থেকেই আমার ভার্মি কম্পোস্ট তৈরির যাত্রা শুরু করি।’- উপরোক্ত কথাগুলো বলছিলেন একজন ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন ও ব্যবহারকারী মোঃ আঃ হামিদ।
শুরুর গল্পটি তানোর উপজেলার একটি প্রত্যন্ত বহড়া গ্রামে ২০১৫ সালে হলেও আঃ হামিদের ভার্মি কম্পোস্ট নিয়ে তাঁর স্বপ্নটি আলোর মুখ দেখতে থাকে ২০১৬ সাল থেকে বারসিক’র সাথে যুক্ত হয়ে একসাথে চলার মাধ্যমে। কারণ শুরুর পর থেকে ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদনে তেমন কোন ধারণা ও অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে খামারটি নষ্ট হতে থাকে। তখন আঃ হামিদেও স্বপ্নে নেমে আসতে থাকে অন্ধকার। কারণ সব মিলিয়ে ৩ লক্ষাধিক টাকা খরচ করে ফেলেছেন। কারণ অনেক বড় করে ইট পাথর দিয়ে চারটি হাউজ করে উপরে টিনের বেড়া দিয়ে চালা দিয়ে কাজটি শুরু করেছিলেন। বিনিময়ে কোন লাভ আসেনি। ২০১৫ সালের মার্চ-এপিল মাসের দিকে আঃ হামিদের পরিচয় হয় বারসিক’র সাথে। তখন জাতীয় পরিবেশ পদক প্রাপ্ত কৃষক ইউসুফ মোল্লা বেঁচে ছিলেন। তিনি তখন সেই খামার দেখে বলেছিলেন, ‘এই খামার তো শেষ হয়ে গিয়েছে, তবে এখনও সময় আছে আবার নতুন করে শুরু করার। সেই থেকেই নতুন করে শুরু।
বারসিক থেকে প্রকাশিত এবং সেকেন্ডারি উৎস থেকে ভার্মিকম্পোস্ট বিষয়ে বিভিন্ন প্রকাশনা দিয়ে সহযোগিতা করা হয় আঃ হামিদকে। প্রশিক্ষণের আয়োজন করা, কৃষক মিটিং করার মাধ্যমে আঃ হামিদ ভার্মি কম্পোস্ট বিষয়ে ধারণা ও অভিজ্ঞতা লাভ করেন। পাশাপাশি নিজেই বিভিন্নভাবে এই কাজটিকে যাচাই বাছাই করে এগিয়ে নিতে থাকেন। নিজের জমিতে ব্যবহার করেন, মাছ চাষের পুকুরও ব্যবহার করতে থাকেন। অন্য কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন ভার্মিকম্পোস্ট ব্যবহারে। নিজ জেলা এবং অন্য জেলায় গিয়ে বিভিন্ন কৃষক সমাবেশে অংশগ্রহণ করেন। উপস্থাপন করতে থাকেন নিজের কাজ ও ভার্মিকম্পোষ্ট ব্যবহারের উপকারিতা। আস্তে আস্তে পরিচিতি বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে ভার্মি কম্পোস্ট বিক্রয়ের হার। নিজের ব্যবহারের পরে তিনি লক্ষ্য করেন কৃষকদের চাহিদা বাড়তে থাকে। তিনি এবার ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন খামার সম্প্রসারণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সে প্রেক্ষিতে পুরোনো ৬ শতাংশ জমিতে তৈরি ৪টি সেডের পাশাপাশি আরো ৩ শতাংশ জমিতে ৬টি সেড তৈরি করলেন ২০২০ সালে। এবার প্রতিমাসে ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন হতে থাকে মাসে ৭৫-৮০ বস্তা (প্রতি বস্তায় ৫ কেজি) ভার্মিকম্পোস্ট সার।
এখনও তিনি কৃষক সভা সমাবেশ এবং কৃষি কেন্দ্রিক অনুষ্ঠানে নিয়মিতভাবেই অংশগ্রহণ করেন। পাশাপাশি সারের চাহিদাও বাড়তে থাকল। তিনি ২০২১ সালে নিজের জমি এবং পুকুরে ব্যবহারের পরও ২৫ হাজার ৩ শত কেজি সার বিভিন্ন কৃষকদের মাঝে বিক্রয় করেন, যা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৪ শত কেজিতে।
আরো বেশি চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন খামারটি আরো বড় করবেন। পুরাতন খামারগুলোর পাশাপাশি ১০ শতাংশ জায়গায় ৩২টি সেডের নতুন আরো একটি খাবার তৈরি করলেন ৪ লক্ষ টাকা ব্যয় করে। এই ব্যয় মেটান তিনি ভার্মিকম্পোস্ট বিক্রয়ের লাভের টাকা থেকেই। এর মধ্য বারসিক থেকে উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগের মাধ্যমে ৩০ হাজার টাকা মূল্যর ভার্মিকম্পোস্ট সেপারেটর মেশিন পেতে সহযোগিতা করা হয়। এই মেশিন পাওয়ার পর তার উৎপাদন আরো বাড়তে থাকে বলে তিনি জানান। এ বিষয়ে বহড়া গ্রামের ভার্মিকম্পোস্ট ব্যবহারকারী কৃষক মোঃ হাবিবুর রহমান (৪৮) বলেন, ‘আমি প্রতি মৌসুমে ১০-১২ বিঘা জমিতে ধান, সীম, গম, সরিষা, মসুর চাষ করি। সেই জমিতে প্রতি মৌসুমেই ৮০-১০০ বস্তা সার আঃ হামিদের থেকে নিয়ে প্রয়োগ করি। এতে করে আমার রাসায়নিক সারের প্রয়োজন কম হয় এবং ফসলের ফলনও ভালো হয়।’ এই গ্রামের অপর একজন কৃষক মোঃ লিয়াকত আলী বলেন, ‘আমাদের অঞ্চলে ফসল চাষে পানি সমস্যা প্রকট কিন্তু আমরা লক্ষ্য করেছি এই ভার্মিকম্পোস্ট ব্যবহারে মাটিতে পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, আমাদের সেচও কম লাগে।’ সেচ কম লাগার কারণ হিসেবে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে ধান চাষে ৬-৮ বার পানি দেওয়া প্রয়োজন হয়। কিন্তু ভার্মিকম্পোস্ট ব্যবহারের জমিতে ৫-৬ বার সেচ দিলেই ধান পরিপক্ক হয়ে যায়।’
একই উপজেলার দুবইল গ্রামের কৃষক মোঃ গোলাম মোস্তফা। তিনি নিয়মিতভাবে প্রতি মৌসুমেই আঃ হামিদের ভার্মিকম্পোস্ট খামার থেকে সার ক্রয় করেন। তিনি বলেন, ‘ভার্মিকম্পোস্ট সার নিয়মিত ব্যবহারের ফলে জমিতে ফলন ভালো হয়। মাটি অনেক দিন অবধি ভালো থাকে।’ মোঃ আঃ হামিদ বলেন, ‘আমার স্বপ্ন ছিলো আমি পরিবেশবান্ধব কৃষি চর্চা করব। এই বলে ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন শুরু করেছিলাম। এখন নিজে ব্যবহারের পরও এখান থেকে আমি ভালো আয় পাচ্ছি। আর এটা ব্যাবহার করে কৃষকরা উপকার পাচ্ছেন। পাশাপাশি রাসায়নিক সারের উপর চাপ কমছে। পরিবেশেরও উপকার হচ্ছে।’