হাওরাঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে পাট বীজ বিতরণ
তলার হাওর থেকে সুমন তালুকদার
হাওরে একক ফসল বোরো ধানের উপর কৃষকদের নির্ভরশীলতা হ্রাসে বোরো ধানের পাশাপাশি বিকল্প ফসল চাষ করে কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ মোকাবেলা এবং শস্য ফসলের বৈচিত্র্য বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষকদের ঝুঁকি হ্রাসে বারসিক ও মদন উপজেলা কৃষি বিভাগের উদ্যোগে ১৪ ও ১৫ মার্চ নেত্রকোনা জেলার মদন উপজেলার দু’টি ইউনিয়নের (মদন সদর ও গোবিন্দশ্রী) ৪টি গ্রামের (দক্ষিণ মদন, বৃ-বড়িকান্দি, কুলিয়াটি ও গোবিন্দশ্রী) ৩৬ জন কৃষককে তিন জাতের (তোষা পাট-৮, মেছতা ও বট) ১০৩ কেজি পাটের বীজ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। পাট বীজ সহায়তা পেয়ে হাওরের কৃষকরা তাদের ২৮.৫ একর জমিতে পাট চাষের উদ্যোগ নিয়েছে।
বারসিক নেত্রকোনা জেলার মদন উপজেলার হাওর অধ্যুষিত দু’টি ইউনিয়নে ২০১৮ সাল থেকে ‘পিপলস্ লেড ক্লাইমেট চেইঞ্জ, এডাপটেশন এন্ড রেজিলেন্স প্রোগ্রাম’ নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আসছে। মার্চ ২০২১ মাসটি প্রকল্পের তৃতীয় বছরের সমাপনী মাস। প্রকল্পের তিন বছরে বারসিক হাওরাঞ্চলের নারী-পুরুষ, কিশোর-কিশোরী, যুব, প্রবীণ, কৃষক-কৃষাণী, শিক্ষার্থী, স্থানীয় সরকার, গণমাধ্যম কর্মী এবং উপজেলা প্রশাসন, প্রাণীসম্পদ বিভাগ ও কৃষি বিভাগের সহযোগিতা নিয়ে বিভিন্ন ধরণের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছে। বিশেষভাবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ মোকাবেলায় এবং হাওরের পরিবেশ উন্নয়নে হাওরে পানি সহনশীল গাছের বনায়ন, দুর্যোগ থেকে হাওরের কৃষি ফসল রক্ষার্থে এলাকা উপযোগি শস্য ফসল ও ধানের জাত নির্বাচনে প্রায়োগিক গবেষণা পরিচালনা, বৈচিত্র্যময় সবজি ও শস্য ফসলের বীজ বিতরণ করা হয়েছে। হাওর এলাকা উপযোগি গাছের চারা (পানি সহনশীল), সবজি, কাঠ ও ফলের চারা উৎপাদনের মাধ্যমে জনগোষ্ঠীর জন্য এসব চারা সহজলভ্যকরণে হাওরে তিনটি নার্সারি স্থাপন ও উন্নয়নে উপকরণ সহযোগিতা প্রদান করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে হাওরের কৃষি ক্ষেত্রে দুর্যোগ মোকাবেলায় এবং দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি থেকে কৃষি ফসল রক্ষায় ধানের বিকল্প ফসল চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণে পরীক্ষামূলকভাবে ভূট্টা, সরিষা, গম, পাট ইত্যাদি বীজ সহযোগিতা প্রদান করা হয়েছে। ধীরে ধীরে হাওরের কৃষকদের মধ্যে ধানের বিকল্প ফসল চাষের আগ্রহ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং হাওরাঞ্চলের (গোবিন্দশ্রী) অনেক কৃষক তাদের জমিতে রবি মৌসুমে ভূট্টা, গম ও সরিষা চাষ করে ভালো ফলন পেয়েছেন। হাওরের কৃষকদের মধ্যে দিন দিন এসব শস্য ফসল চাষের আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।
১০ মার্চ ২০২১ তারিখ ‘গোবিন্দশ্রী তলার হাওর কৃষক সংগঠন’ পরিচালিত হাওর এলাকা উপযোগি শস্য ফসলের জাত নির্বাচনে প্রায়োগিক কৃষি গবেষণাকে কেন্দ্র করে এক কৃষক মাঠ দিবস আয়োজিত হয়। কৃষক মাঠ দিবসে উপজেলা সম্প্রসারণ কৃষি কর্মকর্তা রায়হানুল হক ও উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা দিদারুল ইসলাম উপস্থিত থেকে হাওরে জলবায়ুজনিত কারণে সৃষ্ট দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি থেকে বোরো ধান রক্ষায় ধানের বিকল্প হিসেবে রবি ফসল যেমন-সরিষা, গম, ভূট্টা, ডাল ও পাট চাষ করার পরামর্শ দেন। হাওরের সাধারণত আমন মৌসুমে ধান চাষ করা যায় না। যেসব সামান্য উঁচু জমি রয়েছে সেগুলোতে সামান্য পরিমাণে নামিলা (দেরিতে-ভাদ্র মাসে) আমন ধানের চাষ হয়, যার ফলন খুবই কম হয়। আবার বোরো মৌসুমে যেসব উঁচু জমিতে ধান চাষে খরচ বেশি সেসব জমিতে ধান চাষ না করে রবি ফসল-সরিষা, গম, ভূট্টা, পাট ইত্যাদি, যেগুলো আগাম বন্যার আগেই তোলা যায় এবং হাটু বা কোমর পানিতেও নষ্ট হয়না (পাট) এমন ফসল চাষ করার পরামর্শ দেন। মাঠ দিবসে হাওর বেস্টিত গোবিন্দশ্রী গ্রামের কৃষক-কৃষাণীরা কৃষি কর্মকর্তা ও বারসিক’র কর্মীদের আলোচনা থেকে হাওরের অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে পাট চাষে উৎসাহী হয়ে বারসিক ও কৃষি বিভাগের নিকট থেকে বিনামূল্যে পাট বীজের চাহিদা জানায়।
বারসিক ও উপজেলা কৃষি বিভাগের উদ্যোগে ১৪ ও ১৫ মার্চ মদন ইউনিয়ন ও গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নের ৩৬ জন কৃষককে ১০৩ কেজি তোষা পাট-৮, মেছতা ও বট পাটের বীজ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। তিন জাতের পাট বীজ সহায়তা পেয়ে কৃষকরা হাওরের ২৮.৫ একর জমিতে পাট চাষের উদ্যোগ নিয়েছে। পাট কোমর পানিতেও টিকে থাকতে পারে এবং পাটের ও পাট শলার বাজার মূল্য ভালো হওয়ায় হাওরের কৃষকরা পাট চাষে আগ্রহী হচ্ছে। বারসিক ও উপজেলা কৃষি বিভাগের যৌথ প্রচেষ্টায় হাওরে ধানের বিকল্প ফসল চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে হাওরে জলবায়ুজনিত কারণে কৃষি ক্ষেত্রে সৃষ্ট দুর্যোগ (আগাম বন্যা, আফাল, পোকা-মাকড়ের আক্রমণ ও কোল্ড ইঞ্জুরী) মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। বারসিক’র সহযোগিতায় হাওরের কৃষকরা উপজেলা কৃষি বিভাগের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করে সরকার প্রদত্ত্ব কৃষি সেবাসমূহ পেতে সক্ষম হচ্ছে এবং কৃষি সংক্রান্ত সমস্যা জানাতে পারছে। উল্লেখ্য যে, হাওর বেস্টিত গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নে এর পূর্বে কখনো পাটের চাষ হয়নি। এ মৌসুমেই গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নের কৃষকরা প্রথমবারের মত পাট চাষের উদ্যোগ নিয়েছে।
বারসিক ও কৃষি বিভাগের গৃহীত উদ্যোগের ফলে হাওরে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে কৃষি ক্ষেত্রে দুর্যোগ মোকাবেলায় কৃষকরা উদ্যোগী হচ্ছে এবং সমস্যাগুলো সমাধানে সক্ষম হচ্ছে।