কেঁচো কম্পোস্ট ব্যবহারে কৃষক শাহ্জাহানের উৎপাদন খরচ কমেছে
নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং
কেঁচো কম্পোস্ট দিয়ে সবজি চাষ করে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন নেত্রকোনা জেলার মদন উপজেলার মদন ইউনিয়নে গণেষের হাওরঘেঁষা কুলিয়াটি গ্রামের কৃষক শাহ্জাহান মিয়া। পেশায় কৃষক শাহজাহান মিয়ার চার সন্তানসহ মোট ছয় জনের সংসার। তিন মেয়ে এক ছেলে সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে এইচএসসি, মেজো মেয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী, সেজো মেয়ে ব্র্যাক স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ছে এবং চতুর্থ সন্তান ছেলে এখনও ছোট। ২.৫ শতাংশ বসতভিটার ছোট ঘরে ৬ সদস্য নিয়ে কৃষক শাহ্জাহানের বসবাস। পেশায় কৃষক শাহজাহানের কৃষি জমির পরিমাণ ২.৪০ একর, যার ২ একর জমিতে তিনি বোরো ধানের বিকল্প হিসেবে পাট চাষ করেছেন। ৪০ শতাংশ জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছেন। বোরো ধান চাষে খরচ বেশি হওয়ায় এবং পাট চাষে অপেক্ষাকৃত খরচ কম, পাটের বাজারমূল্য বেশি (পাট ও পাটশলা) এবং বন্যা বা আফালে পাটের কোন ক্ষতি না হওয়ায় তিনি পাট চাষ করেছেন।
কৃষক শাহজাহান বাড়ির সন্নিকটে অন্যের ৮ কাঠা বা ৮০ শতাংশ জমি বছরে ১৫ হাজার টাকায় লিজ নিয়ে বছরব্যাপী সবজি চাষ করে সবজি বিক্রির আয় দিয়ে সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ এবং খাবারসহ সংসারের যাবতীয় খরচ বহন করে আসছেন। কিন্তু সবজি চাষে বীজসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণের (বীজ, সার, কীটনাশক, বাঁশ, সূতা, জিআই তার, পাটশলা ইত্যাদি) উচ্চমূল্যের জন্য সবজি উৎপাদন করে তেমন লাভ হয়না। আবার সবজির বাজারমূল্য কম হলে তো লাভের হার আরও কমে যায়। সবজি উৎপাদনে রাসায়নিক সার, কীটনাশকসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণের ব্যবহার কমিয়ে জৈব উপায়ে সবজি চাষ করে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে তিনি জৈব উপায়ে শাক্ সবজি চাষের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু গোয়ালের গরু থেকে প্রতিদিন যে পরিমাণ গোবর পাওয়া যায় তার প্রায় সবগুলোই জ্বালানি তৈরিতে লেগে যায়। গ্রামে বারসিক’র এক আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করে তিনি কেঁচো কম্পোস্ট এর গুণাগুণ সম্পর্কে জানতে পেরে কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদনে উদ্যোগী হন। কিন্তু কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদনের জন্য মাটি/সিমেন্টের তৈরি চাড়, পলিথিন শীট ও কেঁচোর দরকার হয়। কেঁচো ও উপকরণের জন্য বারসিক’র কর্মীর সাথে যোগাযোগ করলে বারসিক তাকে ৪টি সিমেন্টের রিং, পলিথিন শীট ও কিছু কেঁচো সহায়তা দেয়া হয় এবং কেঁচো উৎপাদন কৌশল শিখিয়ে দেওয়া হয়। উপকরণ সহায়তা পেয়ে তিনি সবজি ক্ষেতের এক কোনে গাছের ছায়ায় সিমেন্টের রিংগুলো বসিয়ে কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন শুরু করেন। প্রথম পর্যায়ে চারটি রিং এ কেঁচো কম্পোস্ট হতে প্রায় তিনমাস সময় লেগে যায়। কেঁচো কম থাকায় কম্পোস্ট হতে বেশি সময় লাগে। তবে তিনমাসে কেঁচোর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদনে সর্বোচ্চ দুই মাস সময় লাগছে।
কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদনে স্ত্রী (গোবর প্রক্রিয়া করা, রিংগুলো তদারকি করা, কম্পোস্ট হয়ে গেলে চালনি দিয়ে চেলে কম্পোস্ট ও কেঁচো আলাদা করা) শাহ্জাহানকে সহযোগিতা করেন। বর্তমানে তিনি ৮ কাঠা জমিতে কেঁচো কম্পোস্ট দিয়ে বারসিক’র নিকট থেকে সবজি বীজ সহায়তা নিয়ে জৈব উপায়ে বৈচিত্র্যময় শাক্ সবজি চাষ করায় উৎপাদন খরচ অনেক কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার কম করায় তার সবজি ক্ষেতে রোগবালাইয়ের আক্রমণও অনেক কমেছে। কেঁচো কম্পোস্ট দিয়ে তার উৎপাদিত শাক্ সবজি দেখতে সুন্দর ও খেতে সুস্বাদু হওয়ায় এলাকার জনগোষ্ঠীর নিকট তার সবজির অনেক চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি শীত মৌসুমে লিজকৃত ৮০ শতাংশ জমিতে লালশাক, মূলা, ডাটা, লাউ, শিম ও খিরা চাষ করেছেন। শুধু খিরা ২২,০০০ টাকায় বিক্রি করেছেন। চলতি গ্রীষ্ম মৌসুমে (খরিপ-১) তিনি কেঁচো কম্পোস্ট দিয়ে বাওয়া ডাটা, ঝিঙ্গা, বেগুন, শসা ও মিষ্টিকুমড়া চাষ করেছেন। গ্রীষ্ম মৌসুমের সবজির অবস্থাও অনেক ভালো হয়েছে বলে তিনি জানান।
এ বিষয়ে কৃষক শাহ্জাহান মিয়া বলেন, ‘আমার বসতভিটায় শুধু ঘর ছাড়া কোন জমি নেই। সবজি চাষের কোন জমি না থাকায় সারাবছর বাজার থেকে সবজি কিনে খেতাম। নিজস্ব ২.৪ একর জমিতে আগে আমি শুধু বোরো ধান চাষ করতাম। বোরো ধান চাষে বীজ, সার, বিষ, লেবারসহ অনেক খরচ হয়, কিন্ত ধান বিক্রি করে সে খরচ তুলে আনা যায় না বরং আরও ঋণগ্রস্ত হতে হয়েছে। তাই আমি এ বছর ২ একর জমিতে ধানের বদলে পাট চাষ করেছি। পাট চাষে খরচ কম, পাটের দাম ও পাটশলার দাম বেশি এবং পাটশলা জ্বালানি হিসেবে ও নিজের সবজি ক্ষেতে মাঁচা তৈরির জন্য কাজে লাগাতে পারি।’ তিনি আরও বলেন, ‘পাট চাষে জমির উর্বরতাও বাড়ে। এবছর আমি কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন করে শ্কা সবজি চাষ করেছি। কেঁচো কম্পোস্ট দেয়ায় শ্কা সবজি খুব ভালো হয়েছে এবং রোগবালাইয়ের আক্রমণ অনেক কম হয়েছে, ফলে আমার উৎপাদন খরচ কম হয়েছে এবং সবজি থেকে ভালো আয় হয়েছে। আমি কেঁচো কম্পোস্ট আরও বেশি করে উৎপাদন করে শুধু কম্পোস্ট দিয়ে শ্কা সবজি উৎপাদন করবো, যাতে মানুষ রাসায়নিক সার ও বিষমুক্ত ভালো খাবার খেতে পারে।’
কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদনে উপকরণ সহযোগিতা প্রদান এবং কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন কৌশল সম্পর্কে জানতে ও জ্ঞানার্জনে কম্পোস্ট গ্রাম পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি বারসিক’র প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।