নাজমা বেগমের বদলে যাওয়া কৃষিজীবন
সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
উপকূলীয় প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত তাদের জীবন ও জীবিকার মান উন্নয়নে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে চলেছে। কখনো পারস্পারিক আলোচনা, কখনো একে অন্যের সমস্যা সমাধানে নিজেদের জ্ঞান দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বিনিময় প্রদান করে চলেছেন। নিজেদের এ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে প্রাণবৈচিত্র্যসমৃদ্ধ কৃষিবাড়ি তোলার উদ্যোগ নিচ্ছে। আর এসকল কৃষি বাড়ির উন্নয়ন এবং নতুন নতুন কৃষি বাড়ি তৈরিসহ প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে আগ্রহী ও উদ্যোগী করে তুলতে কৃষিবাড়ি পরিদর্শন ও অভিজ্ঞতা বিনিময় সফরের আয়োজন করা হয়। এ অভিজ্ঞতা বিনিময় সফরের মাধ্যমে তাদের মধ্যে এক ধরনের সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার মনোভাব তৈরি হয়।
তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি বারসিক’র কর্মএলাকার কৃষক-কৃষাণীদের নিয়ে অল্পনা রানীর কৃষিবাড়ি পরিদর্শন করানো হয়। এসময় অংশগ্রহণকারী কয়েকজন কৃষাণী অল্পনা রানীর কৃষিবাড়ি দেখে তাদের খুবই ভালো লাগে এবং তারা নিজেরা খুবই দ্রুত অল্পনা রানীর মতো কৃষিবাড়ি ও সংগঠন তৈরির আগ্রহ দেখান। এই পরিদর্শনকারীদের মধ্যে একজন হচ্ছেন শ্যামনগর উপজেলার কাশিমাড়ি ইউনিয়নের শংকরকাটি গ্রামের কৃষাণী নাজমা বেগম (৪৪)।
নাজমা বেগমের সংসারের তেমন কোন অভাব নেই। তাঁর স্বামী আগে বিদেশ থাকতেন। নিজেদের প্রায় ৫ বিঘার মতো জমি আছে যার মধ্যে ২ বিঘার মতো ভিটাবাড়ি। তা দিয়ে তাদের খুবই ভালোভাবে চলে যায়। স্বামী, ছেলে মেয়ে ও শুশুরসহ নাজমা বেগমের সংসারে ৫ জন সদস্য। বিগত কয়েক মাস আগে ধুমঘাট গ্রামের অল্পনা রানীর কৃষিবাড়ি পরিদর্শনের পাশাপশি পাখিমারা গ্রামে বোনের বাড়িতে বেড়াতে যান নাজমা বেগম এবং সেখানে বোনদের তৈরিকৃত পাখিমারা নারী সংগঠন দেখেন। সেখানে বোনের কাছে জানেন যে, তারা কিভাবে সংগঠন করলেন এবং সংগঠন করে কি কি কাজ করে কাদের সহায়তায় এ সংগঠন তৈরি হলো। পাখিমারা ও ধুমঘাট গ্রামের নারী সংগঠন ও তাদের উদ্যোগ দেখে উদ্যোগী হয়ে নিজেই একটি সংগঠন ও কৃষিবাড়ি তৈরি চেষ্টা করতে থাকেন নাজমা বেগম।
বর্তমানে নাজমা বেগম তার বাড়িটিকে একটি কৃষি বাড়িতে রূপ দিয়েছেন। সেখানে বছরব্যাপী বিভিন্ন ফসল ফলান তিনি। বর্তমানে তার বাড়িতে ফলজ ও কাঠ জাতীয় উদ্ভিদ নারকেল, খেজুর, তাল, তেতুল, কদবেল, আম, জাম, লেবু, আমড়া, পেয়ারা পেঁপে, সবেদা, কলা, ডালিম, নইল রয়েছে। এছাড়া কাঠ জাতীয় শিশুফুল, নিম, আকাশমনি, জিবলী, মেহগনি ও বাঁশ আছে। সবজির মধ্যে রয়েছে ঢেঁড়স, ডাটাশাক, পুঁইশাক, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, চালকুমড়া, তুরুল, ঝিঙ্গা, বরবটি, শিম, উচ্ছে, কুশি, শসা, লালশাক, পালংশাক, আলু, চুবড়ি আলু, বেগুন, ওলকপি, মূলা, হলুদ, কচুরমুখী, ওল, মানকচু, জলপানকচু, সোলাকচু ইত্যাদি। পরবর্তী বছরে ফসল চাষাবাদের জন্য তিনি বীজ সংরক্ষণ করেন। পাশাপাশি অচাষকৃত উদ্ভিদ খাদ্য ও ঔষধি হিসাবে পেপুল, ক্ষুদকুড়ি, আমরুল, কলমি, সাদা গাদো, লাল গাদো, বউটুনি, সেঞ্চি, কাটানুটে, আদাবরুন, তেলাকচু, থালারুটি, ঘোড়াসেঞ্চী, ঘুমশাক, ঘেটকুল, নোনা গাদো, গিমেশাক, থানকুনি, কাথাশাক, হেলাঞ্চ, কলমি (লাল সাদা), বাকসা, নিমুখা, কালোবিসারী, পাথরকুচি, হেন্না, ঝাউগাছ, তিতবেগুন, তুলসি, উলু, মিশরিদানা সংরক্ষণে রেখেছেন। পুকুরে আছে রুই, কাতলা, শোল, কৈ, পুটি, চিংড়ি, তেলাপিয়াসহ বিভিন্ন ধরনের স্থানীয় মাছ। একই সাথে পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণে হাঁস ১৫টি, মুরগি ২৮টি পালন করেন নাজমা বেগম।
নাজমা বেগম এভাবে তাঁর বাড়িকে একটি কৃষি বাড়ির তৈরির উদ্যোগ চলমান রেখেছে। কৃষি বাড়ির তৈরির পাশাপাশি গ্রামের ১৭ জন নারীকে সংগঠিত করে ‘শংকরকাটি কৃষি নারী সংগঠন” নামে একটি নারী সংগঠন তৈরি করেন। সংগঠন তৈরির পর থেকে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা, পাড়া মেলা, সঞ্চয়, সরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ কার্যক্রম চলমান রেখেছেন। এরকম উদ্যোগ নেওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে নাজমা বেগম বলেন, ‘বাড়িতে ঘর সংসার দেখাশুনা ছাড়া তেমন কোন কাজ ছিলনা। নিজের সময়টাকে কাজে লাগানোর সাথে যদি গ্রামের নারীদের একত্রিত করে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সেবা পেতে তাদের সহায়তা করি তাহলে নিজের একটি সুনাম তৈরি হবে। সাথে বাড়িতে তৈরি বিভিন্ন ধরনের খাদ্য খেতে পারবো সংসারে খাবারের মধ্যে ভিন্নতা আসবে পুষ্টিকর খাবারও পাওয়া যাবে। এজন্য কৃষি বাড়ি তৈরি ও সংগঠন তৈরির উদ্যোগ গ্রহন করি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি যেমন অন্য নারীদের দেখে উদ্বুদ্ধ হয়েছি ঠিক আমাকে দেকে যেন অন্য নারী উদ্বুদ্ধ হয়। অন্য নারীরা পারলে আমরা কেন পারবো না। এমনটা সবসময় মনে হতো। আর এটা সম্ভব হয়েছে অন্য নারী সংগঠনের কার্যক্রম দেখে। আমি যে কাজ করছি এ কাজে আমার পরিবার সবসময় পাশে থেকে সহায়তা করছে। আমার শুশুর একজন কৃষক। তিনি বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ দেন এবং কোন উদ্ভিদে কি কি গুনাগুণ সে বিষয়ে তিনি আমাকে ধারণা দেন। এলাকার মানুষ এখন আমার বাড়ি দেখতে আছে এবং অনেক নারী এ কাজে আগ্রহী হচ্ছে।’
নাজমা বেগম জানান, বাড়িটিকে আরও বেশি বেশি বৈচিত্র্য ভরে তোলার ইচ্ছা আছে তাঁর। তাঁর মতো গ্রামীণ অন্য নারীরাও তাদের বাড়িকে প্রাণবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ করে তুলতে পারে, নিরাপত্তা দিতে পারে পরিবারের খাদ্য চাহিদার। যদি তাদেরকে সে পথে চালিত করা যায়। উপকূলীয় এলাকায় কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণের পাশাপাশি স্থায়িত্বশীল জীবনযাত্রা পরিচালনার একটি বাস্তব উদাহরণ হলো নাজমা বেগম। নাজমা বেগমের মতো গ্রামীণ নারীর এই জ্ঞান-দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন করা হলে গ্রামের প্রতিটি বাড়ি হয়ে উঠবে বৈচিত্র্যময় প্রাণের সম্ভার যা খাদ্যনিরাপত্তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।